৪০ বছর ধরে জাহাজে চালক হিসেবে কাজ করেছেন গোলাম কিবরিয়া (৬৫)। বয়স বেড়ে যাওয়ায় কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন তিনি। এ জন্য ভাগনে সবুজ শেখকে (২৫) নিয়ে যান জাহাজে। গোলাম কিবরিয়ার ইচ্ছা ছিল, সবুজকে কাজ শিখিয়ে জাহাজের হাল ধরানোর উপযুক্ত করে তুলবেন। মামার ডাকে ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জাহাজে ওঠেন সবুজ। ১৪ দিনের মাথায় দুজনেরই জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডে।
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করা এমভি আল-বাখেরা নামের জাহাজে হত্যাকাণ্ডের শিকার সাতজনের মধ্যে দুজন হলেন গোলাম কিবরিয়া ও তাঁর ভাগনে সবুজ শেখ। তাঁদের বাড়ি ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা ইাউনিয়নের জোয়োইড় মোড় গ্রামে। গোলাম কিবরিয়া ওই জাহাজের মাস্টার ছিলেন। আর সবুজ জাহাজের লস্কর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে জোয়োইড় মোড় গ্রামে গোলাম কিবরিয়ার বাড়িতে গিয়ে এক শোকাবহ পরিবেশ দেখা যায়। তাঁর মা আছিয়া বেগম (৭৮) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দুই দিন আগেও আমার ছোয়ালের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার ছোয়ালের কোনো শত্রু ছিল না। আমার ছোয়ালরে কারা যে মাইরা ফেলল। কী হবে ওর বিধবা বউ আর সন্তানের?’
সাড়ে ৭ শতাংশ জমির ওপর একটি আধা পাকা ঘর আছে গোলাম কিবরিয়ার। মরদেহ বহনের জন্য দুটি খাটিয়া এনে রাখা হয়েছে সেখানে। গ্রামের কবরস্থানে তাঁদের জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর আইনিপ্রক্রিয়া শেষে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে লাশ এসে পৌঁছাবে বলে জানা গেছে।
বাড়িতে কথা হয় কিবরিয়ার প্রতিবেশী মো. আবুল হোসেনের (৪৬) সঙ্গে। তিনি পেশায় মিনিবাসের চালক। জাহাজের চাকরি ছেড়ে পরবর্তী পেশাজীবনের পরিকল্পনার কথা সম্প্রতি আবুল হোসেনকে বলেছিলেন কিবরিয়া। আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, জাহাজের চাকরি শেষ করে এলাকায় এসে একটি টেম্পো কিনে তা চালানোর জন্য। কিন্তু রাজি হননি গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেছিলেন, “না আর চালক হব না। এবার নিরিবিলি দিন কাটাব। মেয়ের বিয়ের পর বাড়িতে এসে একটি চায়ের দোকান দেব। তাতেই আমার দিন চলে যাবে।”’
চার ভাই এক বোনের মধ্যে গোলাম কিবরিয়া ছিলেন সবার বড়। তাঁর একমাত্র বোন রাজিয়া বেগম। রাজিয়ার সন্তান সবুজ শেখ। বেশ কয়েকটি পেশায় কাজ করেও কোথাও থিতু হতে পারেননি সবুজ। এ জন্য ভাগনেকে নিজের কাছে নিয়ে জাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছিলেন গোলাম কিবরিয়া।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাজিয়া বেগম বলেন, ‘কোনো কাজ করত না সবুজ। ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করত। ভাই গোলাম কিবরিয়া বলে “তোর ছেলেকে আমার কাছে দে, কাজ শিকিয়ে জাহাজের হাল ধরিয়ে দেব।” এ আশায় ১৪ দিন আগে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে মামার সঙ্গে কাজে যোগ দেয় সবুজ। কিন্তু মামা ও ভাগনের যে এ পরিণতি হবে তা তো স্বপ্নেও ভাবিনি।’
সবুজের ভাই মঞ্জুর শেখ (৪৪) ও বিপ্লব শেখ (৩৯) মনে করেন, এটি ডাকাতি নয়, এটি হত্যাকাণ্ড। কারণ, ঘাতকেরা জাহাজের কোনো জিনিসপত্রে হাত দেয়নি। শুধু মানুষগুলোকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এর পেছনে অবশ্যই অন্য কোনো রহস্য আছে। রহস্য বের করার দাবি জানান তাঁরা।
গত ৪০ বছর ধরে মাস্টার হিসেবে কাজ করেন গোলাম কিবরিয়া। তিনি দুই–তিন মাস পরপর বাড়িতে আসতেন জাহাজ লোড-আনলোডের সুযোগে। তা–ও দুই তিন দিনের বেশি থাকতে পারতেন না। বড় মেয়ে হাবিবা আক্তারের (২২) বিয়ের দিন ঠিক করা হয় আগামী ১০ জানুয়ারি। দুই মাস আগে বিয়ের কাবিনও সম্পন্ন হয়েছে।
কিবরিয়ার স্ত্রী ওয়াহিদা বেগম (৩৮) বলেন, ‘আমি কি কইবো। আমার কওয়ার কিছু নাই। ওরে আমার কি সর্বনাশ হইয়া গেল রে।’ এ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।