হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন জমে বিপুল পরিমাণ চিকিৎসাবর্জ্য। অথচ কোনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেই বর্জ্য শোধন বা বিনষ্টের উদ্যোগ নেয়নি।
ঠাকুরগাঁওয়ে সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলোর নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া নেই। চিকিৎসাবর্জ্য কোনোভাবে শোধন বা বিনষ্ট না করেই সড়কের পাশে অন্য আবর্জনার সঙ্গে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, তেমনি হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকলে কোনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না।
ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরে সরকারি দুটি হাসপাতাল রয়েছে। একটি ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল, আরেকটি ২০ শয্যার মা ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র। ৪ উপজেলায় একটি করে ৫০ শয্যার হাসপাতাল আছে। এর বাইরে ৭৯টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ১০২টি রোগনির্ণয় কেন্দ্র রয়েছে। সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছোট-বড় অস্ত্রোপচার হয়। প্রতিদিনই জমে বিপুল পরিমাণ চিকিৎসাবর্জ্য। অথচ সরকারি বা বেসরকারি কোনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেই বর্জ্য শোধন বা বিনষ্টের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর পঞ্চগড় কার্যালয় সূত্র জানায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকলে কোনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। আর এ ছাড়পত্র না থাকলে আইন অনুযায়ী বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল বা প্যাথলজি চালানোর অনুমোদন পাওয়ার কথা নয়। ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের সামনে হাসপাতালের বর্জ্যে ভরা একটি ভ্যানগাড়ি দেখা যায়। হাসপাতালের এসব বর্জ্য কোথায় নেওয়া হচ্ছে, তা দেখার জন্য গাড়িটির পিছু নেওয়া হয়। দেখা যায়, বর্জ্যগুলো শহরের গড়েয়া সড়কের পাশের কবরস্থানের সামনে ফেলা হচ্ছে। সেসব বর্জ্যের মধ্যে রক্ত-পুঁজমাখা গজ, রক্তসঞ্চালনের ব্যাগ, সিরিঞ্জ, স্যালাইন সেট, ওষুধের মোড়ক দেখা যায়।
ভ্যানগাড়ির চালক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পৌরসভার স্যারেরা হামাক এইঠে ফেলাবা কহিছে। মুই ফেলছু।’
এ সময় বর্জ্যের ভেতর থেকে এক ব্যক্তিকে সিরিঞ্জ, স্যালাইনের পাইপসহ আরও কিছু জিনিস বাছাই করতে দেখা যায়। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো তিনি বিক্রি করবেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র থেকে ১১ ধরনের বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসবের মধ্যে ভয়ানক হচ্ছে সংক্রামক বর্জ্য। এ ছাড়া আরও আছে অ্যানাটমিক্যাল ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য। এসব বর্জ্য নিয়ম অনুযায়ী বিশেষভাবে বিনষ্ট ও শোধন করতে হবে।
অথচ জেলা শহরের হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলোর একটিতেও তা করা হয় না। শহরের তিনটি বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁদের ক্লিনিকের বর্জ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য পৌরসভার নির্ধারিত গাড়ি ও কর্মচারী রয়েছে। তাঁরা তাঁদের মাসিক চুক্তিতে টাকা দেন। এগুলো নিয়ে গিয়ে কোথায় ফেলা হয়, তা তাঁরা জানেন না।
জেলা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সমিতির সভাপতি জুলফিকার আলী জানান, তাঁরা চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল চত্বরের পশ্চিম অংশে হাসপাতালের একটি ইনসাইনেরেটর (চিকিৎসাবর্জ্য বিনষ্ট করার চুল্লি) রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এর আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে চিকিৎসাবর্জ্য। হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ শাহজাহান নেওয়াজ সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তিনি বলেন, ‘মাঝখানে বদলি হলেও আমি ২০ বছর ধরে হাসপাতালের ইনসাইনেরেটরটি এ রকম নষ্ট দেখছি।’
হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সিভিল সার্জন নুর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, চিকিৎসাবর্জ্য বিনষ্ট করার চুল্লি ব্যবহারের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এসব বর্জ্য নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে ফেলে আসে। ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের নষ্ট ইনসাইনেরেটরটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সময়ই চুল্লিটি নির্মাণ করা হয়। কয়েক মাস চলার পরই তা নষ্ট হয়ে গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, সড়কের পাশে চিকিৎসাবর্জ্য ফেলার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।