দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তখনো পেটে দানাপানি পড়েনি গৃহবধূ খুকু মণির (২৫)। কীভাবেই–বা পড়বে? গত তিন দিনের ধারাবাহিক জলোচ্ছ্বাস, প্রায় ৩০ ঘণ্টা ধরে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব আর টানা বৃষ্টি তাঁদের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। তিন দিনে না পেয়েছেন খেতে, না হয়েছে ঘুম। পুরো জীবনই ছিল ছন্নছাড়া।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঘরে জমে থাকা হাঁটুপানি নামলেও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে সব জিনিসপত্র। কাদাপানিতে ঘরের মেঝে একাকার। খুকু মণি ঘরের তছনছ অবস্থা গুছিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন।
বরিশাল নগরের পলাশপুর ৮ নম্বর গুচ্ছগ্রাম এলাকার বাসিন্দা খুকু মণির স্বামী-সন্তান-শাশুড়িকে নিয়ে সাতজনের সংসার। স্বামী ফোরকান মিয়ার ইজিবাইক চালানোর আয় দিয়েই টেনেটুনে চলে সংসার। ঘূর্ণিঝড় রিমাল তাঁদের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে।
সরেজমিনে গুচ্ছগ্রাম এলাকায় দেখা গেল, ভাঙাচোরা সরু সড়কে এখনো কাদাপানি। কীর্তনখোলা নদী থেকে আসা মোহাম্মদপুর খালের কিনার ঘেঁষে গুচ্ছগ্রামের খুপরিঘরগুলোও কাদাপানিতে একাকার।
খুকু মণি অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো কাপড়, মালামাল গোছগাছ করছেন। দুপুরে খাওয়া হয়নি। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই হেসে বললেন, ‘এই তো দ্যাহেনই কেমন আছি মোরা। তিন দিন ধরে ঘরে হাঁটুপানি। রাতে ঘুম নেই। রান্নাঘর ও চুলায় পানি আর পানি। কোনো রকম চাল, আলু সেদ্ধ করে জীবনটা চালিয়ে নিচ্ছি। আজ দুপুরের দিকে পানি নেমে গেছে। এরপর থেকে গোছগাছ করছি। এ জন্যি বিকেল হলেও দুপুরের আহার হয়নি।’
আক্ষেপ করে খুকু মণি বললেন, ‘এই রহম জীবন মোগো যে, পেরতেকটা বইন্না, অমাবস্যা, পুন্নিমার বড় জোয়ারে মোগো জীবন পানিতে ভাসে। এই দুঃখের কথা কারে কমু!’
খুকু মণির আক্ষেপ শুনে বের হওয়ার পর মো. হিরণ নামের আরেক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। অনেকটা জোর করে তাঁর জীর্ণশীর্ণ খুপরি ঘরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে অন্ধকার, কাদাজলে একাকার। চালের টিনগুলো ভেঙে পড়েছে। পেশায় রাজমিস্ত্রি হিরণ স্ত্রী, মা ও দুই সন্তান নিয়ে ওই ঘরেই থাকেন। দুর্যোগে সেই আশ্রয় এখন এলোমেলো। হিরণের স্ত্রী তানিয়া আক্তার (২৪) বললেন, ‘তিন রাইত ধইর্যা চোহে ঘুম নাই। ঘরদুয়ার পানিতে তলাইয়্যা আলহে। চহিতে (চকি) পানি। রানমু হেই জোত্তরও (অবস্থা) আলহে না। স্বামীর আয়-রোজগারও আলহে না। ক্যামনে যে দিনগুলা যায় কইয়া বুঝাইতে পারমু না।’
পলাশপুরে সাতটি গুচ্ছগ্রামে কয়েক হাজার পরিবারের বসবাস। সব পরিবারের দুর্দশার চিত্র একই। পলাশপুরের সড়ক ধরে ফেরার সময় চারপাশে দুর্গন্ধ, কাদাজল দেখা গেল। ক্ষীর্ণকায় অনেক শিশু খেলছে। বেশির ভাগ শিশুই অপুষ্টির শিকার। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ওদের ঘুম হয়নি। ঠিকমতো খাবার পায়নি তিন বেলা।
দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে জেলে জসিম উদ্দীনের (৩৭) চারজনের সংসার। টানাপোড়েনের সংসার নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল কীর্তনখোলার পূর্ব পাড়ে চরকাউয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কয়লাঘাট এলাকায়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে সেই ঠাঁইটুকু হারিয়ে এখন নিঃস্ব জসিম। ঝড়ে ঘরের মাঝ বরাবর গাছ পড়ে ঘরটি বিধ্বস্ত হয়েছে। এখন গৃহহীন জসিমের পরিবার। হাতে টাকা নেই। ঘরে চাল-সওদা নেই। কীর্তনখোলার ঢেউয়ের মতোই নীরব কান্না তাঁর বুকে।
আজ বিকেলে চরকাউয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিধ্বস্ত ঘরের সামনে বিমর্ষ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন জসিম। সন্তানদের নিয়ে পাশের এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জসিম বলেন, ‘এই ঘর ক্যামনে তুলমু, প্যাডেরতা জোডামু না ঘর উডামু। সবাইর সামনে কানতেও পারি না। একা গোপনে চোহের পানি হালাই। কী যে হরমু, কিচ্ছু কইতে পারি না।’
আরেক জেলে আল আমিনের ছোট্ট টিনের ঘরটিও ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। এখন পরিবার নিয়ে কোথায় থাকবেন, কীভাবে ঘর তুলবেন—সেটি নিয়ে আল আমিনের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ঘূর্ণিঝড় তাঁর জীবনটা দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে। অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘বইন্নায় মোগো জীবনডারে এক্কেবারে ভাইঙ্গা-চুইর্যা দেছে।’
পাশের চরমোনাই ইউনিয়নের গ্রামগুলোতেও বন্যাদুর্গত মানুষের দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। জোয়ারে-জলোচ্ছ্বাসে তিন-চার দিন ভাসতে ভাসতে ওই ইউনিয়নের পশুরিকাঠি, চাঁদেরহাট, চরহোগলা গ্রামের বাসিন্দাদের দিশেহারা করে তুলেছে। সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে বিপদগ্রস্ত, দুর্গত মানুষের চোখে-মুখে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বাড়ছিল।
চাঁদেরহাট গ্রামের মো. হালিম মিয়া মলিন চোখে তাকিয়ে ছিলেন জলোচ্ছ্বাসে তছনছ হওয়া ঘরের ভেতরে। বললেন, ‘মোগো এই দুর্দশা কবে শ্যাষ অইবে, কইতে পারেন?’