জীবন বদলের কারিগর

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন আরিফা বেগম। নারীশিক্ষার বিস্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার সাহাজউদ্দিন মণ্ডল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক আরিফা বেগম

দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর ভালো চাকরি করতে পারতেন। শহরে থেকে ঝামেলাহীন ও আয়েশি জীবন যাপন করতে পারতেন। এসব কিছুই করেননি তিনি। নিজ এলাকার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তাঁদের জীবন বদলে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল তাঁর। সেই লক্ষ্যে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। প্রতিষ্ঠা করেন উচ্চবিদ্যালয়। তাঁর এই বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র এখন সরকারিসহ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।

প্রত্যন্ত এলাকার ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের হাজি গফুর মণ্ডলপাড়ায়। এর নাম সাহাজউদ্দিন মণ্ডল ইনস্টিটিউট। ১৯৯৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন একই এলাকার  প্রয়াত মো. আতিয়ার রহমানের মেয়ে আরিফা বেগম। শুরু থেকেই তিনি বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত পারিশ্রমিক ছাড়া এখানে চাকরি করেন তিনি। দুস্থ পরিবারের সন্তানদের বিনা বেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।  এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী, ৯ জন শিক্ষক এবং ৬ জন কর্মচারী আছেন। শিক্ষাদানের পাশাপাশি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। এ জন্য পেয়েছেন জয়িতা এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সম্মাননা পুরস্কার।

গ্রামে ফিরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল আরিফা বেগমের। মহতী এই উদ্যোগের পেছনের কারণ জানতে চাইলে আরিফা বলেন, তাঁদের গ্রামের বাড়িতে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। হাজি গফুর মণ্ডলপাড়া থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে উচ্চবিদ্যালয় ছিল। ছেলেরা কষ্ট করে গেলেও মেয়েরা যেতে পারত না। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর অনেক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়ে যেত। অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের অভাবের কারণে দূরে গিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেত না। এতে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ত। বিষয়গুলো তাঁর মনকে নাড়া দিয়েছিল। এ কারণেই পরিবারের সদস্যরা মিলে হাজি গফুর মণ্ডলপাড়ায় ১ একর ৫১ শতাংশ জমির ওপর দাদার নামে সাহাজ উদ্দিন মণ্ডল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন।

শুরুটা বেশ কঠিন ছিল আরিফা বেগমদের জন্য। ৩৫ জন শিক্ষার্থী এবং ৬ জন শিক্ষক দিয়ে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। দীর্ঘদিন বেশ কয়েকজন শিক্ষক বিনা বেতনে চাকরি করেছেন। ২০০১ সালে এমপিওভুক্তির পর থেকে বেতন পাচ্ছেন।

আরিফা বেগম বিদ্যালয় চালানোর পাশাপাশি দুস্থ পরিবারের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে সহায়তা দিচ্ছেন। এ রকমই গফুর মণ্ডলপাড়ার কলেজছাত্র রবিন ব্যাপারী। রবিন বলে, ‘মাত্র দেড় বছর বয়সে আমাদের ফেলে চলে যান বাবা মঙ্গল ব্যাপারী। উপায় না পেয়ে আমাকে নিয়ে মা ডালিমা বেগম নানাবাড়ি গফুর মণ্ডলপাড়ায় চলে আসেন। এর পর থেকে মা রাস্তায় কাজ করে সংসার চালাতেন। যখন হাইস্কুলে ভর্তি হব, তখন আরিফা ম্যাডাম জানতে পেরে সাহায্যের হাত বাড়ান। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এখন পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ তিনিই চালিয়ে আসছেন।’

এজাজুল হক নামের এক তরুণ এখন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তিনি বলেন, ‘ছোট থাকতেই বাবা হজরত আলী মারা যান। পরিবারের ৩ বোন ও আমাকে নিয়ে মহাবিপাকে পড়েন মা। মানুষের বাড়ি কাজ করে কোনোভাবে খাবারের খরচ জোটাতেন। আরিফা ম্যাডামের সঙ্গে একদিন মায়ের পরিচয় হওয়ার পর তিনি আমাদের খরচ জোগান দেন। শুধু সংসার খরচই নয়, এখন পর্যন্ত পড়াশোনার সব খরচ তিনি দিচ্ছেন। প্রতি মাসে সংসারের চাল-ডালসহ অন্যান্য খরচ ম্যাডাম দিচ্ছেন।আরিফা ম্যাডামের অবদানের কথা আমরা কোনো দিনও ভুলব না।’

আরিফা বেগম ফরিদপুর মহিম ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮২ সালে এসএসসি পাস করেন। ফরিদপুর সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এইচএসসি এবং ওই কলেজ থেকে ১৯৮৬ সালে ডিগ্রি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাস করেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ডিগ্রি নিয়েও সরকারি চাকরির চেষ্টা করেননি। নিজের গ্রামে এসে প্রতিষ্ঠা করেছেন উচ্চবিদ্যালয়। 

শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার পাশাপাশি আরিফা বেগম সামাজিক বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৫ সালে গ্রামের নারীদের নিয়ে গড়েন প্রান্তিক বহুমুখী নারী কল্যাণ সমিতি। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে গোয়ালন্দ উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে সম্মাননা পান। ২০১৬ রাজবাড়ী জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে সম্মাননা পান। ২০০৪ ও ২০১৭ সালে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে সম্মাননা পান। ২০২৩ সালে গোয়ালন্দ উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন। 

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রবীণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নির্মল কুমার চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘আরিফা বেগম একজন সফল সংগ্রামী নারী। তাঁর কাজের স্বচ্ছতা দেখে আমি নিজেও বিস্মিত। আমি আমার সাধ্যমতো পাশে থেকে বিদ্যালয় পরিচালনায় সহযোগিতা করছি।’