রাজবাড়ীতে টার্মিনাল পার্কিং ফির নামে ঢাকাগামী দূরপাল্লার বাস থেকে আবারও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বাসমালিকদের সংগঠন রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ এই টাকা নিচ্ছে।
শহরের শ্রীপুর এলাকায় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের অবস্থান। তবে চাঁদা আদায় করা হয় চার কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক সড়কের মুরগির ফার্ম এলাকায়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাস থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ হয়। তবে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আবারও টাকা আদায় শুরু হয়েছে। টার্মিনাল পার্কিং ফি-৫০ টাকার স্লিপ ধরিয়ে ঢাকাগামী নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক দূরপাল্লার বাসপ্রতি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
এ সম্পর্কে জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ সৃষ্টির পর থেকে টাকা নেওয়ার রীতি চালু রয়েছে। এই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করা হয়। দৌলতদিয়া, গোয়ালন্দ মোড়, রাজবাড়ীর বড়পুল, মুরগির ফার্মসহ যেসব স্টেশনে শ্রমিকেরা কাজ করেন, তাঁদের বেতন প্রদানসহ যাবতীয় খরচ এই টাকা থেকে বহন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের দ্বিবার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পঞ্চমবারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইবাদত আলী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন রাবেয়া পরিবহনের স্বত্বাধিকারী আবদুর রাজ্জাক (লিটন)।
সড়ক পরিবহন মালিক সূত্রে জানা যায়, রাজবাড়ীর ওপর দিয়ে ঢাকাগামী হানিফ, গোল্ডেন লাইন, রাবেয়া, জামান, সৌহার্দ্য, সপ্তবর্ণা, এফকে, রাজধানী এক্সপ্রেস, শ্যামলী, তুহিন, সরকার, এসবি সুপার ডিলাক্স, দিগন্ত, রোজিনা, লালনশাহ, বিআরটিসি, এমএম পরিবহনসহ কয়েকটি দূরপাল্লার যাত্রীবাহী পরিবহন যাতায়াত করে। এর মধ্যে রাবেয়া, জামান, সৌহার্দ্য, সপ্তবর্ণা, সরকার ও এমএম পরিবহনের মালিক রাজবাড়ী জেলা পরিবহন মালিক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। অন্য দূরপাল্লার পরিবহনগুলো কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও ঢাকা বাস মালিক সমিতির অন্তর্ভুক্ত।
৫ আগস্টের আগে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও ঢাকা বাস মালিক সমিতির অন্তর্ভুক্ত দূরপাল্লার বাস থেকে প্রতি ট্রিপ বাবদ ২৮০ টাকা আদায় করা হতো। এই তিন জেলা সমিতির অন্তর্ভুক্ত পরিবহন প্রতিদিন ৫০টির মতো ট্রিপ দিত। রোজিনা ও দিগন্ত পরিবহন মালিক ঢাকার গাবতলী সমিতির হওয়ায় টাকা নেওয়া হয় না। রোজিনা ও দিগন্ত পরিবহনের ১০টি ট্রিপ বাদে অন্য পরিবহনের প্রায় ৪০টি ট্রিপ চলাচল করে। অন্য বাস থেকে টার্মিনাল পার্কিং চার্জ বাবদ ৫০ টাকা ছাড়া ২৩০ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। প্রতি ট্রিপ থেকে অতিরিক্ত ২৩০ টাকা করে গড়ে প্রতিদিন ৯ হাজার এবং প্রতি মাসে প্রায় ৩ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো।
কুষ্টিয়া মালিক সমিতির গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপ বাবদ ১৫০ টাকা করে নেওয়া হয়। অথচ আমাদের হাতে ৫০ টাকার স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়।মনির হোসেন, বাসচালক
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চাঁদা আদায় বন্ধ ছিল। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক বাস থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেছে জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ। বর্তমানে প্রতিটি বাস থেকে ২৫০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার লালন, এফকে, রাজধানী এক্সপ্রেস ও এসবি নামক পরিবহন রয়েছে। এর বাইরে আরও কিছু পরিবহন রয়েছে।
ঢাকাগামী লালনশাহ পরিবহনের সুপারভাইজার আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫০ টাকা করে আদায় করছে। অন্যান্য পরিবহন থেকে ১৫০ টাকা নিলেও লালনশাহ থেকে ২৫০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। ১৫০ টাকা দিতে চাইলে আমাদের গাড়ি আটকে রাখার হুমকি দেয় সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের লোকজন।’
ঢাকাগামী রাজধানী এক্সপ্রেসের চালক মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের কুষ্টিয়া মালিক সমিতির গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপ বাবদ ১৫০ টাকা করে নেওয়া হয়। অথচ আমাদের হাতে ৫০ টাকার স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়।’
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চাঁদা আদায় বন্ধ ছিল। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক বাস থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেছে জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ। বর্তমানে প্রতিটি বাস থেকে ২৫০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
সরেজমিনে একদিন
গতকাল মঙ্গলবার এ প্রতিবেদক যাত্রী হিসেবে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী লালন শাহ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে বাসটি রাজবাড়ী শহরের মুরগির ফার্ম এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে এক যুবক বাসটি থামানোর সংকেত দেন। গাড়ির গতি কমার পর বাসের সুপারভাইজার নেমে ওই যুবকের হাতে একটি ৫০০ টাকার নোট দেন। যুবকটি ভাঙতি ২০০ টাকা রেখে বাকি ৩০০ টাকা সুপারভাইজারকে ফেরত দেন। এ সময় নীল রঙের একটি কাগজও দেওয়া হয়। এতে লেখা আছে ‘রাজবাড়ী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল পার্কিং ফি আদায়ের রশিদ’ টার্মিনাল ফি ৫০ টাকা। ইজারাদার আবদুর রাজ্জাক লিটন (পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক)।
টাকা দেওয়ার পর বাসের সুপারভাইজার মো. স্বপন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজবাড়ী পরিবহন মালিক সমিতির লোকজন টার্মিনাল ফির নামে বাড়তি টাকা আদায় করছেন। ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত ঢাকাগামী প্রতি ট্রিপে ২৮০ টাকা দিতে হতো। সরকার পতনের পর টাকা আদায় কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন টার্মিনাল ফি বাবদ ৫০ টাকার রশিদ দিয়ে আরও ১৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে।
পরিবহন মালিক ও প্রশাসনের ভাষ্য
সরকার পতনের পর জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী ইবাদত আলী আত্মগোপনে রয়েছেন। গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পরিমল কুমার সাহা বলেন, ‘আমরা কুষ্টিয়ায় যে টাকা দিচ্ছি, সেই টাকাই রাজবাড়ী থেকে নিচ্ছি। এখানে অন্যায় বা অবৈধভাবে চাঁদা তোলা হচ্ছে না। কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় একইভাবে টাকা নেওয়া হয়। পৌরসভা থেকে এ বছর প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়ে টার্মিনাল বন্দোবস্ত নিয়েছি। এই টাকার অংশ হিসেবে ৫০ টাকা করে পার্কিং চার্জ নেওয়া হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার শামিমা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টার্মিনাল ফির অতিরিক্ত টাকা আদায়সংক্রান্ত বিষয়টি আমার জানা নেই।’ তাৎক্ষণিকভাবে তিনি রাজবাড়ী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে খোঁজখবর নিয়ে চাঁদা আদায় বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।