৭ বছর বয়সী শিশু আরিফ হোসেন ও জয়া খাতুন (৬) এখনো বিশ্বাস করে, তাদের মা ফিরে আসবে। সেই আশায় দুই ভাই–বোন পথে চেয়ে বসে আছে।
গত বুধবার গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে তাদের মা মোসা. আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) মারা যান। বুধবার গভীর রাতে তাঁর লাশ সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ গ্রামে এনে দাফন করা হয়।
নিহত আঞ্জুয়ারা কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের চর নাটিপাড়া গ্রামের মাজেদা খাতুন ও মৃত মন্টু মিয়া দম্পতির মেয়ে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আঞ্জুয়ারা ছোট। একই ইউনিয়নের সালাল গ্রামের জামাল মিয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আঞ্জুয়ারা-জামাল দম্পতির দুই সন্তান আরিফ ও জয়া স্থানীয় চরগিরিশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টসে সেলাই মেশিন অপারেটর ছিলেন আঞ্জুয়ারা।
বুধবার রাতে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে কাজীপুরে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছে আঞ্জুয়ারার দুই সন্তান। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সালাল গ্রামে আঞ্জুয়ারার বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনেরা। আঞ্জুয়ারার শাশুড়ি নূরজাহান বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বউমার ইচ্ছা ছিল, তাঁর ছেলেমেয়ে দুইটা বালো মানুষ অয়, বালো লেহাপড়া করে। আর আমরা সবাই জানি বালো থাকি।’
শিশু আরিফ বলে, ‘মঙ্গলবার রাতেও মা আমাদের দুই ভাই–বোনকে ভাত তুলে খাইয়েছে। বুধবার সকালে তারাতারি অফিসে যাওয়ায় ভাত ও পাঙাশ মাছ রান্না করে রেখে খেতে বলে যান। বোন খেয়েছে, কিন্তু আমি কিছুই খাইনি। সকাল থেকেই না খেয়ে ছিলাম। মা বলেছিল, খুব তারাতারি বাসাতে আসবে। কিন্তু আসেনি।’ সে বলে, ‘মা বলেছিল শুক্রবার তার ছুটি। তাই আমাদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসবে। সে জন্যই আমরা অপেক্ষায় ছিলাম।’
শিশু জয়া বলে, ‘মা বাড়িতে এলেই আমাদের জন্য নতুন জামাকাপড় আনত। কাজে যাবার সময় আমাদের টাকা দিত। আগে নানুবাড়িতে থেকে সেখানকার স্কুলে পড়তাম। গত বছর নানু মারা গেলে মায়ের ইচ্ছায় দাদুবাড়িতে ভাইয়ার সাথে ভর্তি হয়েছি।’
চরগিরিশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহিদুল ইসলাম বলেন, আঞ্জুয়ারার ছেলেমেয়ে দুটো খুবই ভালো। তারা দুই ভাই–বোন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পূজার ছুটির পর স্কুলে না আসায় বুধবার সকালে আঞ্জুয়ারার সঙ্গে কথা বলেন। বিকেলে মৃত্যুর খবর পান। এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন।
স্বজনেরা জানান, জামাল ও আঞ্জুয়ারার বিয়ে হয় ২০১৪ সালে। তাঁরা দুজনই তখন তেজগাঁও এলাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। দুই বছর আগে তাঁরা গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার দুটি কারখানায় কাজ নেন।
জামাল জানান, দুজন মিলে প্রতি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকায় সন্তানদের নিয়ে চলা সম্ভব নয়। সে কারণে ছেলেমেয়েদের দাদাবাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বিদ্যালয় ছুটি হলে অল্প দিনের জন্য দুই সন্তানকে নিজেদের কাছে রাখতেন। চার বছর আগে আঞ্জুয়ারার বাবা মো. মন্টু মারা যান। আঞ্জুয়ারার ছোট দুই ভাইকে নিয়ে মা মাজেদা খাতুন সিরাজগঞ্জে থাকেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁদের দেখভালের দায়িত্বও নিয়েছিলেন আঞ্জুয়ারা।