ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টাকা। নতুন ট্রান্সফরমার কিনতে অর্থনৈতিক চাপে পড়ছেন গ্রাহকেরা।
ঢাকার ধামরাই উপজেলায় ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩–এর কুশরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন এলাকা থেকে গত ১৪ মাসে ৫৮টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এসব চুরির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু চুরি যাওয়া কোনো ট্রান্সফরমার উদ্ধার করা যায়নি।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানিয়েছেন, ট্রান্সফরমার চুরির পর তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নতুন ট্রান্সফরমারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটাই নিয়ম বলে জানিয়েছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান ট্রান্সফরমার পবিসের হলেও চুরি হওয়ার পর নতুন ট্রান্সফরমারের জন্য গ্রাহকদেরই টাকা দিতে হয়। পবিসের নিয়মানুযায়ী প্রথমবার চুরির জন্য গ্রাহককে নতুন ট্রান্সফরমারের জন্য অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এর পর চুরি হলে ট্রান্সফরমারের পুরো মূল্য পরিশোধ করতে হয় গ্রাহকদের।
গত সোমবার ধামরাইয়ের বালিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বালিয়া ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন খেলার মাঠের পাশের সড়কের একপাশের বিদু্যতের খুঁটির সঙ্গে একটি ট্রান্সফরমার লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে তালা দেওয়া রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, গত বছর এই স্থানের টান্সফরমারটি অকেজো হয়ে গেলে এই ট্রান্সফরমারের আওতায় ৮৫টি বিদু্যতের মিটারের প্রতি গ্রাহক ৫০০ টাকা করে দিয়ে নতুন ট্রান্সফরমার আনেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে ট্রান্সফরমারটি চুরি হয়ে যায়। এরপর ৮৫ জন গ্রাহক জনপ্রতি বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে বাড়তি ১ হাজার ১০০ করে টাকা দিয়ে আবারও নতুন ট্রান্সফরমার লাগান। সর্বশেষ গত ২২ জুন রাতে ট্রান্সফরমারটি আবার চুরি হয়ে যায়। এবার গ্রাহকেরা জনপ্রতি ২ হাজার ২০০ টাকা জমা দিয়ে নতুন ট্রান্সফরমারের ব্যবস্থা করেন।
বারবার ট্রান্সফরমার চুরি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন মাঠের ট্রান্সফরমারের আওতাধীন এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জোসনা বেগম বলেন, ‘আমরা দিন আনি দিন খাই। আমাদের পক্ষে হুট করে এতগুলা টাকা দেওয়া অনেক কষ্টের। এই নিয়া তিনবার এক ট্রান্সফরমারের জন্য জরিমানা দিলাম। শেষবার ঈদের আগে হঠাৎ করে ২ হাজার ২০০ টাকা দিতে হইলো। আপনাগো কাছে সামান্য হলেও আমাগো কাছে এইটা অনেক টাকা। এই টাকার জন্য এবারের ঈদে একটু ভালোমন্দ খাইতেও পারিনাই।’
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, দক্ষ না হলে কারও পক্ষে ভারি এসব ট্রান্সফরমার বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে চুরি করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুতের কিছু অসাধু ব্যক্তি এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। ট্রান্সফরমারে মূল্যবান তামার কয়েলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকে। মূলত দামি কয়েলের কারণেই ট্রান্সফরমার চুরি হয়।
আজাদ মিয়া নামে এক কাঠমিস্ত্রি বলেন, ‘একটি ট্রান্সফরমারের ওজন সাড়ে আট মণ। এত বড় একটা জিনিস কীভাবে চুরি হয়? আমাদের ধারণা, এর সঙ্গে পল্লী বিদ্যুতের লোকেরা জড়িত। কারণ, সাধারণ কোনো মানুষ এটি খুলতে গেলে কারেন্টের শক খেয়ে মারা যাবে। অভিজ্ঞতা আছে বলেই নিতে পারছে।’
পল্লী বিদ্যুতের কুশরা আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মে মাস থেকে চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত ওই কার্যালয়ের আওতাধীন এলাকা থেকে ৫৮টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনার তথ্য আছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত চুরির সঙ্গে জড়িত কাউকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার করা যায়নি চুরি হওয়া কোনো ট্রান্সফরমার।
কুশরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনদের পদক্ষেপ নিতে হবে। চুরি রোধ করতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ট্রান্সফরমার চুরি রোধে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ট্রান্সফরমার স্থাপনের ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচনে সচেতন হতে হবে। লোকজনের যাতায়াত বা বসতি রয়েছে—এমন জায়গায় ট্রান্সফরমার স্থাপন করতে হবে। ট্রান্সফরমারকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে নতুন করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে কয়েক লাখ টাকার বিদু্যতের তারসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারি সম্পদ রক্ষায় ও উদ্ধারে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।