‘আমি কী নিয়া বাঁচব? আমার বাবারে ফিরায় দাও’

কলেজছাত্র সৌরভ মালোকে হারিয়ে কান্না থামছে না তাঁর মা–বাবার। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নের মাঝিকান্দা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

‘মা আমি ভাঙ্গা পর্যন্ত এসেছি। এখন ইজিবাইকে উঠব, বাড়িতে আসছি।’ মুঠোফোনে সৌরভ মালোর (২০) সঙ্গে তাঁর মা বীথি রানী মালোর এটাই ছিল শেষ কথা। ছেলের সঙ্গে এসব কথা হয় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে। কিন্তু রাত ১০টা বেজে গেলেও ছেলে ফিরে না আসায় দুশ্চিন্তায় পড়েন মা–বাবা। ছেলেকে বারবার ফোন করেন তাঁরা। ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে আর ফোন ধরে না।

অস্থির হয়ে বাবা স্বপন মালো চলে আসেন বাড়ি থেকে আনুমানিক ১১ কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গায়। ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে ভাঙ্গা থানার পুলিশকে খবর দেন। পরে রাত দুইটার দিকে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যান তিনি। পরদিন শুক্রবার পুলিশের ফোন পেয়ে স্বপন ছুটে যান ভাঙ্গায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, ভাঙ্গা বাজার এলাকায় সেতুর নিচে কুমার নদের তীর থেকে তাঁর ছেলে সৌরভের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

সৌরভ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নের মাঝিকান্দা গ্রামের বাসিন্দা। শনিবার সকাল নয়টার দিকে নগরকান্দার মাঝিকান্দা গ্রামের সৌরভের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর স্বপন ও বীথি। প্রতিবেশীরাও নীরবে দাঁড়িয়ে দুই চোখের পানি মুছছেন। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা যেন তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

দুই ভাই–বোনের মধ্যে সৌরভ ছিলেন ছোট। তাঁর বোন সম্পা মালো ১৪ বছর বয়সে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১ বছর আগে। এরপর থেকে সৌরভই ছিলেন এই পরিবারের ‘অন্ধের যষ্টি’।

‘এখন কী নিয়ে বাঁচব। আমার ও সৌরভের তো কোনো শত্রু নেই। কারা আমার ছেলেরে খুন করল? আমি কী নিয়ে বাঁচব?’ বিলাপ করতে করতে বাবা স্বপন মালো খালি এসব প্রশ্ন করছিলেন।

অন্যদিকে সৌরভের মা বীথি রানী মালো শোকে কাতর। তিনি বলছিলেন, ‘আমার কাইনকে (সৌরভ) মাইরা ফেলা হইছে। ওরে কারা আমার এ সর্বনাশ করল? আমার কাইনকে ছাড়া আমি কী নিয়া বাঁচব। আমার বাবারে ফিরায় দাও।’

কলেজছাত্র সৌরভ মালো ছবি: সংগৃহীত

একটি দোচালা ঘর। পাশে পাঠখড়ির বেড়া দিয়ে তৈরি ছোট একটি রান্নাঘর। জানা গেল, এটাই সৌরভদের একমাত্র সম্বল। স্বজনেরা বলেন, সৌরভের বাবা স্বপন মালো মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাচ্চর এলাকায় এক ব্যক্তির নৌকায় থেকে পদ্মায় মাছ ধরার কাজ করেন। এ সামান্য আয়ে সংসার চলত না। সৌরভ শহরের রঘুনন্দনপুর এলাকায় তাঁর ছোট মামা দেবু সরকারের বাড়িতে থেকে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে পড়ালেখা করতেন। পাশাপাশি ফরিদপুর শহরের হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজারে শ্যামলের মাছের আড়তে খণ্ডকালীন কাজ করে কিছু রোজগার করে পড়াশোনার খরচ চালাতেন।

গত বুধবার সৌরভ ঢাকা গিয়েছিলেন চাচাতো বোনের জন্মদিন পালন করতে। বৃহস্পতিবার তিনি বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু বাড়ি আর ফিরতে পারেননি। অনেক আশা ছিল সৌরভের মা–বাবার ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবেন। রোজগার করবেন। সংসারের অভাব দূর হবে। কিন্তু তাঁদের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।

সৌরভের প্রতিবেশী শশধর মালো (৬৩) বলেন, ‘গ্রামের সোনার টুকরো ছেলে ছিল সৌরভ। তার এ মৃত্যু আমরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না।’ এ হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।

এদিকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে সৌরভের লাশ তুলে দেওয়া হয় স্বজনদের হাতে। শুক্রবার সন্ধ্যায় সৌরভের লাশ নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। এরপর গ্রামের শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জিয়ারুল ইসলাম বলেন, সৌরভের কাছে প্রায় ২০ হাজার টাকা, হাতে স্বর্ণের আংটি, রুপার ব্রেসলেট ও মুঠোফোন পাওয়া গেছে। লাশের মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর জখমের চিহ্ন রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, এটি ছিনতাইয়ের কোনো বিষয় নয়; এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এ ব্যাপারে থানায় হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে।