মাদারীপুরের শিবচরে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে নিহত হিরু মাতুব্বরের মা হিরুনি বেগমের আহাজারি। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের আর্য্যদত্তপাড়া এলাকায়
মাদারীপুরের শিবচরে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে নিহত হিরু মাতুব্বরের মা হিরুনি বেগমের আহাজারি। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের আর্য্যদত্তপাড়া এলাকায়

‘পোলাডারে বাঁচাইতে হাত–পাও ধরছি, তবুও ওরা কোপাইয়া মাইরা ফালাইলো’

‘আমার পোলাডারে যখন ওরা (হামলাকারীরা) ঘিরা ধরলো, তখন আমি আর ওর বাপ খুনিগো হাত–পাও ধরছি, কইছি আমার একমাত্র পোলাডারে তোরা মারিছ না। অনেকবার আকুতি–মিনতি করছি, তবুও ওরা আমার পোলারে চোখের সামনে কোপাইয়া মাইরা ফালাইলো। আমার বাপজানরে ছাড়া আমি ক্যামনে বাঁচুম? কী হইবো আমাগো?’

কথাগুলো হিরু মাতুব্বরের মা হিরুনি বেগমের (৫০)। আহাজারি করতে করতে চোখের সামনে একমাত্র ছেলেকে কুপিয়ে হত্যার বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন তিনি।

হিরু মাতুব্বর (৩০) পেশায় রাজমিস্ত্রি। তিনি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের আর্য্যদত্তপাড়া এলাকায় এসকেন্দার মাতুব্বরের ছেলে। গতকাল সোমবার দুপুরে স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে হিরু মাতুব্বরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

হিরুনি বেগম ও এসকেন্দার মাতুব্বর দম্পতির চার সন্তান। এর মধ্যে তিন বোনের একমাত্র ভাই হিরু মাতুব্বর। অন্যদিকে হিরুও চার সন্তানের বাবা। তাঁর তিন কন্যাসন্তান ও ছয় মাস বয়সী একটি পুত্রসন্তান আছে। হিরুই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

হিরুর স্ত্রী রোজিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী রাতের বেলা কাম কইরা দেরি কইরা ঘুমাইছে। বেলা ১২টার দিকে ঘুম থেকে উইঠা দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাড়ির পাশেই একটা দোকানের কাছে গেছিল। ওখানেই হেরে (হিরুকে) একা পাইয়া শত্রুরা কোপাইয়া মাইরা ফালায়। আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? আমার সন্তানগো কী হইবে? সংসারডা আমরা ভাইসা গেলো।’

আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে সরেজমিনে আর্য্যদত্তপাড়া এলাকায় হিরু মাতুব্বরের বাড়িতে দেখা যায়, বাড়িভর্তি লোকজন। নিহত হিরুর তিন শিশুকন্যা ও তাঁর স্ত্রী রোজিনা বেগম কান্নাকাটি করছেন। পাশেই ঘরের উঠানে মা হিরুনি বেগম ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে আহাজারি করে যাচ্ছেন। প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বাড়ির আশপাশের পরিবেশ কিছুটা থমথমে। এলাকায় লোকজন তেমন নেই। বাজারের দোকানপাটও বন্ধ ছিল।

নিহত হিরুর বোনের স্বামী এমদাদ মাতুব্বরের বাড়িও আর্য্যদত্তপাড়া এলাকায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফরাজিরা (স্থানীয় বিএনপির একটি পক্ষ) মূলত এলাকায় ঢুকছিল একটা মার্ডার করতে। তাদের টার্গেট ছিল মালেক মোল্লার কাউকে পেলে খুন করার। কিন্তু তাঁদের কাউকে না পেয়ে পাইছে হিরুকে। হিরু দাঁত ব্রাশ করতে করতে ঘর থেকে ৪০০ মিটার দূরে একটি দোকানের সামনে যায়। তখনই ফরাজিদের লোকজন হিরুকে ঘিরে ধরে। তখন বাড়ির মহিলারা হিরুকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করে; কিন্তু ওরা হিরুকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। হিরুর মা-বাবার চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটেছে।’

হিরুর বড় বোন ইতি বেগম বলেন, ‘পুরো পরিবারটি হিরুর ওপর ছিল। ওর বাচ্চাগুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওরা এখনো বোঝে না ওদের বাবা আর নেই। বড় মেয়েটা শুধু কান্না করছে। হত্যাকারীরা শুধু হিরুকে হত্যা করেই চলে যায় নাই। আমাদের আশপাশের কমপক্ষে ৭টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালাইছে। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, ওদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’

হত্যার ঘটনায় গতকাল দিবাগত রাত দুইটার দিকে শিবচর থানায় হিরুর বাবা এসকেন্দার মাতুব্বর বাদী হয়ে ৬৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৬০ থেকে ৭০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলায় সুমন নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

মামলার বাদী ও নিহত হিরুর বাবা এসকেন্দার মাতুব্বর বলেন, ‘আমার একমাত্র পোলাডারে ওরা খুন করছে। হামলাকারী সবাই টুকু ফরাজির লোকজন। পুলিশ আসামিদের ধরছে না। এলাকায় অভিযান চালালে পুলিশ আসামিদের ধরতে পারবে। আমি শুধু আমার পোলার হত্যাকারীগো বিচার দেইখা মরতে চাই।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দত্তপাড়া এলাকায় বিএনপির কোনো কমিটি নেই। গত ১৫ বছর বিএনপির লোকজন এলাকায় ছিলেন না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এলাকায় বিএনপির প্রভাব বাড়তে থাকে। শিবচর উপজেলাজুড়েই বিএনপির নেতা-কর্মীরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পাঁচ ভাগে বিভক্ত। এর প্রভাব পড়েছে দত্তপাড়া ইউনিয়নেও। এখানে বিএনপি নেতা মালেক মোল্লার সঙ্গে টুকু ফরাজির বিরোধ শুরু থেকে লেগে ছিল। দুজনই এলাকায় নিজেদের আধিপত্য দেখাতে বেশ সক্রিয়। যদিও টুকু ফরাজি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও এলাকায় আলোচনা আছে।

শিবচর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জিল রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টুকু ফরাজি নব্য বিএনপি নেতা হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। তাঁর কারণেই ওই এলাকায় দ্বন্দ্বের সৃষ্টি।’

অভিযোগের বিষয় জানতে টুকু ফরাজির বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিবেশী শাহাদাত আকন বলেন, ‘টুকু ভাই বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী। তাঁর বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তিনি কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।।’

শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোকতার হোসেন আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, আজ মঙ্গলবার দুপুরে নিহত হিরুর লাশের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে লাশটি হস্তান্তর করা হয়েছে। বিকেলে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হবে। ওসি আরও বলেন, আসামিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় টুকু ফরাজিসহ অন্য আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।