সকালটা ধীরে ধীরে ফরসা হয়ে উঠছে। হালকা শীত আছে। কুয়াশাও হালকা। কিছু নারী-পুরুষ হাঁটতে বেরিয়েছেন। যাঁর যাঁর মতো এদিক-ওদিক ছুটছেন। শহরের একটি গলিপথ দিয়ে হনহন করে ছুটছিলেন নূর ইসলাম (৫০)। কাঁধে কোদাল, হাতে ঝোলানো টুকরি। টুকরির মধ্যে ভাঁজ করা বাজারের একটি খালি ব্যাগ। গামছা দিয়ে গলা-মাথা প্যাঁচানো।
মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে সাতসকালে শ্রমিকের হাট বসে। নানা দিকের শ্রমিকেরা এসে ভিড় করেন। নূর ইসলামও কাজের উদ্দেশ্যে সেদিকেই ছুটছেন। দেরি হলে কাজ না-ও পেতে পারেন। এক দিন কাজ না পাওয়ার অর্থ, আরও কিছু দেনা বাড়া।
শহরের আলাউদ্দিন সড়কে গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নূর ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাইল সাড়ে ৬০০ টেকা (টাকা) রুজি করছিলাম। ৫ কেজি চাউল কিনছি, ১ কেজি লবণ কিনছি, আধা কেজি পিঁয়াজ কিনছি, আড়াই শ রসুন কিনছি। মাছ আর আনছি না কাইল। সবকিছু কিনি আর টেকা রইছে (থাকে) না। এক কেজি তরকারি কিনলে ৫০–৬০ টেকা লাগে।’ তিনি বলেন, ‘কাজ সব দিন মিলে না। আইজ খালি হাতে বাইর অইছি। কাজ পাইতাম (পেতে) পারি, না-ও পাইতাম পারি। কিতা করমু (কী করব) আর।’
নূর ইসলামের বয়স ৫০ বছর। এই দীর্ঘ ভ্রমণে কোনো অবসর ছিল না, এখনো নেই। তবে কথা বলার মধ্যে মুখে মৃদু একটা হাসি আছে। এই একটা জায়গায় হয়তো জীবন তাঁকে কাবু করতে পারেনি। সবকিছুকে সহজ করে মানিয়ে নেওয়ার একধরনের সহজাত শক্তি বঞ্চনার মতো জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। হয়তো এই শক্তিতেই হাসিমুখে পোড় খাওয়া জীবনের কথাগুলো বলতে পারেন তিনি।
অবস্থার কথা কইয়া (বলে) লাভ নাই। কেউ শুনতো চায় না। পয়সাঅলার লগে মাতন (সাথে কথা বলা) যায় না। তারার যেমন খুশি চলতে পারে।নূর ইসলাম, শ্রমিক, মৌলভীবাজার
নূর ইসলামের বাড়ি সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে। বাড়িতে এখনো বাপ-দাদার ভিটা আছে। কিন্তু শেষ কবে বাড়িতে গেছেন, সেটা আর মনে করতে পারেন না। সেই ছোটবেলা বাবার হাত ধরে মৌলভীবাজার এসেছিলেন। দেখতে দেখতে ৩৫-৪০ বছর কেটে গেছে। এখনো এখানেই থিতু হয়ে আছেন। বাবা ট্রাক-শ্রমিকের কাজ করতেন। তিনিও বড় হয়ে বাবার পথেই হেঁটেছেন। অন্য কোনো পথ, অন্য কিছু করার কথা মাথায় আসেনি। তবে ১০-১২ বছর ধরে আর ট্রাকে কাজ করেন না। টুকরি-কোদাল নিয়ে প্রতি সকালে বাসা থেকে বের হন। এটিই এখন তাঁর জীবিকার পথ।
মৌলভীবাজার শহরের কাজীরগাঁও এলাকায় থাকেন নূর ইসলাম। আগে যে ঘরে ভাড়া থাকতেন, সেখানে গ্যাসের সংযোগ ছিল। মালিকের ইচ্ছা হয়েছে, কিছুদিন হলো গ্যাস সংযোগ কেটে দিয়েছেন। কিন্তু কেন কাটা হলো, এটা তিনি জানেন না। এখন লাকড়ির চুলাতেই রান্নাবান্না চলে। এক ছেলে ও এক মেয়ে তাঁর। মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ত। টাকার জন্য এবার আর ভর্তি করাতে পারেননি। মেয়ের পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ছেলে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে।
নূর ইসলাম জীবনের সমস্যা-সংকটের কথা খুব একটা বলতে চান না। তিনি বলেন, ‘কষ্টমষ্ট করি কাম (কাজ) করি। অবস্থার কথা কইয়া (বলে) লাভ নাই। কেউ শুনতো চায় না। পয়সাঅলার লগে মাতন (সাথে কথা বলা) যায় না। তারার যেমন খুশি চলতে পারে।’
আগের চেয়ে মজুরি বেড়েছে, কিন্তু সংসার ঠিকমতো চলে না নূর ইসলামের। তাঁর ভাষায়,Ñ‘আগে ৩০ টাকা থাকি ৬০ টাকা রুজি করছি। সংসার ভালোমতো চলছে। বেশি অভাব বুঝছি না। অখন (এখন) দিনে ৬০০ টেকা, সাড়ে ৬০০ টেকা রুজি করি। কিন্তু ঠিকমতো চলতাম পারি না। সংসার চালানোই কঠিন।’ তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে এক দিন পারলে মাছ কিনি। নাইলে ডাইল-ডিম। অখন (এখন) ডাইল-ডিমরও দাম বাড়ছে। আর মাংস হঠাৎ টেকা বেশি অইলে মন চাইলে কিনি।’
মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে প্রতিদিন কয়েক শ শ্রমজীবী মানুষ ভিড় করেন। এই ভিড়েরই একজন নূর ইসলাম। এখানে দরদামে পোষালে কাজে যান। সব দিন কাজ পাওয়াও যায় না। কাজ পেলে একটু স্বস্তি থাকে, অন্তত চাল-ডালটা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবেন। না হলে দোকানদারের সামনে গিয়ে হাত পাততে হয়। নূর ইসলাম বলেন, ‘কাজ না পাইলে দোকান থাকি (থেকে) বাকি-টাকি নেই। কাম পাইলে আবার দিলাই (দিয়ে দিই)।’
মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম হয়, চৌমোহনাতে আর আসতে হয় না। বাসা থেকেই পরিচিতজন কাজের জন্য তাঁকে ডেকে নিয়ে যান। অনেক দিন ধরে একই কাজ করছেন। একটা পরিচিতিও তৈরি হয়ে গেছে।
বেলা বাড়ছে। নূর ইসলামের তাড়াও বাড়ছে। চৌমোহনাতে যেতে দেরি হলে কাজ ফসকে যেতে পারে। ওখানে ততক্ষণে অনেক শ্রমিকের ভিড় জমে গেছে। ‘কিতা করমু (করব) আর। জীবনটা এখানেই শেষ করলাম’—বলতে বলতে হাঁটা শুরু করলেন তিনি।