ছাত্রলীগের নির্যাতন

‘চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কী করতে পারি জানিস?’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

‘ওনারা আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তাঁরা বলতে থাকেন, “চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কী করতে পারি জানিস তুই? কোনো আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে?”’

নির্যাতনের এমন ভয়াবহ বর্ণনার লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। গত রোববার দিবাগত রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সাড়ে ৪ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন তিনি। আজ মঙ্গলবার দুপুরে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পৃথকভাবে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাঁদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শাহাদাত হোসেন বলেছেন, রাতভর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এমন এক ছাত্রীর লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। সেটির বিষয়ে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে এ ঘটনা ঘটান। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।

অভিযুক্ত সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। ওই মেয়ে মিথ্যা বলছে। হয়তো এক কুচক্রী মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

লিখিত অভিযোগে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী বলেন, গত বুধবার প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য তিনি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে ওঠেন। বৃহস্পতিবার তাবাসসুম নামের এক ছাত্রী তাঁর কক্ষে দেখা করতে যেতে বলেন। কিন্তু অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে দেখা করেননি তিনি। এর পর থেকেই তাঁর ওপর চড়াও হন তাঁরা। পরে তাবাসসুমের কক্ষে গেলে ভয়ভীতি দেখান এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। তাঁরা বলতে থাকেন, তাঁদের না জানিয়ে কেন তিনি হলে উঠেছেন। শনিবার রাতে তাঁর ওপরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। রোববার বিকেলে প্রভোস্ট ও সহকারী প্রক্টরের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মীমাংসা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘রোববার দিবাগত রাত ১১টার দিকে সানজিদা চৌধুরী ওরফে অন্তরাসহ ৭-৮ জন আমাকে একটি গণরুমে নিয়ে যান। সেখানে কথায় কথায় এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। আপনারা কেন মারছেন বলতে গেলে, ওনারা আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তাঁরা বলতে থাকেন, “চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কী করতে পারি জানিস তুই? কোনো আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে তোর?” পা ধরে মাফ চাইতে গেলে লাথি মারেন। আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। বুকের ওপর হাত দিয়ে জোরে থাবা মারেন এবং গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখেন। একপর্যায়ে তাঁরা একটা ময়লা গ্লাস তাঁকে দিয়ে চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেন এবং সেটার ভিডিও ধারণ করেন। তারপর তারা বলতে থাকেন, “জামা খোল”, জামা খুলতে না চাইলে তাঁরা আবার মারধর শুরু করেন এবং জোর করে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন।’

ভুক্তভোগী ছাত্রী অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, ভিডিওগুলো তাঁদের কাছে সংরক্ষণ করা। তাঁরা ভিডিও ধারণ করে বলেছেন, ‘যদি বাইরের কাউকে এ কথা বলিস, তাহলে তোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে দেব। যাতে তুই কাউকে মুখ দেখাতে না পারিস।’ সানজিদা বলেন, ‘তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব, যা বলেছি তা মনে থাকে যেন!’ টর্চার শেষে রাত সাড়ে তিনটার দিকে অন্য একটি গণরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সোমবার সকালে জীবন বাঁচাতে হল থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান ভুক্তভোগী। এদিন সানজিদাসহ নির্যাতনে অংশ নেওয়া সবাই একাধিকবার ফোন দেন কিন্তু ভয়ে তিনি কারও ফোন ধরেননি। আজ সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন।