চলতি মৌসুমে এই সেচখালের কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে। তবু এতে পানি আসে না। সম্প্রতি সাঁথিয়ার পুন্ডরিয়া গ্রামে
চলতি মৌসুমে এই সেচখালের কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে। তবু এতে পানি আসে না। সম্প্রতি সাঁথিয়ার পুন্ডরিয়া গ্রামে

খালে পানি নেই, বোরো নিয়ে বিপাকে কৃষক

অব্যবস্থাপনার কারণে পাবনা সেচ প্রকল্প অকার্যকর হতে বসেছে। অব্যবহৃত থাকায় এই প্রকল্পের বেশ কিছু সেচখাল ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। আবার নিয়মিত ও যথাযথভাবে সংস্কার না করায় বহু সেচখালে ঠিকমতো পানি পৌঁছাচ্ছে না। এতে সেচের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯০ শতাংশই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেচখালগুলো অকার্যকর থাকায় পাম্প দিয়ে জমিতে সেচ দিতে গিয়ে ফসল আবাদের খরচ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এতে কয়েক হাজার কৃষক বিপাকে পড়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯২ সালে ৩৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পাবনা সেচ প্রকল্প চালু হয়। এ জন্য বেড়া উপজেলার বৃশালিখায় হুরাসাগর নদের পাড়ে পানি তোলার জন্য ও কৈতলায় যমুনা নদীর পাড়ে পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হয় শক্তিশালী দুটি পাম্পস্টেশন। এ ছাড়া এলাকার জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য ছোট-বড় অসংখ্য সেচখাল, নিষ্কাশনে খাল, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, জলকপাট (স্লুইসগেট), কালভার্ট নির্মাণ করা হয়।

পাবনা সেচ প্রকল্পের অবকাঠামোর জন্য ইতিমধ্যেই একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে বন্ধ সেচখালগুলো যেমন পুনরুজ্জীবিত হবে, তেমনি নতুন নতুন এলাকায় সেচখালও নির্মাণ করা হবে। ফলে সেচের আওতা অনেক বাড়বে।
অমিতাভ চৌধুরী, নির্বাহী প্রকৌশলী, পাউবোর বেড়া কার্যালয়

পাউবো সূত্রে জানা যায়, পাবনা সেচ প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৪২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রধান সেচখাল ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৯টি অপ্রধান, ৪৭টি শাখা ও ৪ শতাধিক ছোট সেচখাল নির্মাণ করা হয়।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন সেচখাল, পানিনিষ্কাশন খাল নিয়মিত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই প্রকল্পের মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় ৩২ বছরে সেচখাল ও এর অন্যান্য অবকাঠামো দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে অনেক এলাকার ছোট সেচখাল ভরাট হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কোনো কোনোটি আবার মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। কোথাও কোথাও এসব সেচখাল দখল করে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটও তৈরি করেন স্থানীয় লোকজন।

পাউবো জানিয়েছে, চলতি বছরে ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যে সেচখালগুলো রয়েছে, তা দিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে না।

পাউবো কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেচ প্রকল্পের পানি পেলে কৃষকদের সারা বছরে তিন ফসল উৎপাদনের জন্য প্রতি বিঘায় পাউবোকে মাত্র ১৮০ টাকা দিতে হয়। অথচ সেচের পানি না পাওয়ায় শুধু বোরো আবাদেই একজন কৃষকের সেচযন্ত্রের মাধ্যমে সেচ দিতে বিঘায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সরেজমিনে বেড়ার চাকলা, দমদমা, খাকছাড়া এবং সাঁথিয়ার পুন্ডরিয়া, শামুকজানি, বায়াসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জমির পাশ দিয়ে যাওয়া সেচখালগুলোতে পানি নেই। এসব এলাকার অর্ধশতাধিক সেচখাল ভরাট হয়ে গেছে।

পুন্ডরিয়া গ্রামের কৃষকেরা জানান, তাঁদের গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া টি-৬ সেচখালে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পানি আসছে না। তবে এবারের সেচ মৌসুমের আগে এই সেচখালের পূর্ব দিকে মেরামত করায় কিছু অংশে খুব অল্প পানি আসছে। এই সেচখালের পশ্চিম দিকের পুরো অংশ ভেঙেচুরে মাটির সঙ্গে মিশে রয়েছে। অথচ একসময় এই সেচখালের পানিতে কৃষকেরা ফসলের আবাদ করতেন। এই এলাকার কৃষকেরা প্রায় ১০ বছর ধরে সেচযন্ত্রের মাধ্যমে চাষাবাদ করে আসছেন।

টি-৬ সেচখালের আওতাভুক্ত চাকলা-পুন্ডরিয়া-শামুকজানি পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই এলাকার সেচখালগুলো অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এরপর দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় এই সেচখালের পুরো অংশই ১০ বছর ধরে বন্ধ ছিল। আমি অনেক দৌড়াদৌড়ি করে পাউবোকে দিয়ে চলতি মৌসুমে কিছু অংশের কাজ করিয়েছি। এতে এই সেচখালের কিছু অংশে অল্প পরিমাণ পানি এলেও বেশির ভাগ অংশে এখনো পানি আসে না।’

সাঁথিয়ার পুন্ডরিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক, সিদ্দিকুর রহমান, আবদুল মুন্নাফসহ পাঁচ থেকে ছয়জন কৃষক জানান, একসময় এ এলাকার কৃষকেরা সেচখালের পানিতে সব ধরনের ফসল আবাদ করতেন। এতে তাঁদের নামমাত্র খরচ হতো। কিন্তু প্রায় ১০ বছর ধরে সেচখালে পানি না আসায় সবাই এখন সেচযন্ত্র দিয়ে সেচ দিচ্ছেন। এতে তাঁদের সেচের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সম্প্রতি বেড়া উপজেলার দমদমা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, টি-৫ সেচখালটি বিলীন হওয়ার পথে। সেচখালের পাশেই জায়গা রয়েছে গ্রামের আলহাজ হোসেনের। সেচখাল ও তাঁর নিজের জায়গায় মাটি ফেলে ভরাট করে ঘর তুলছিলেন তিনি। আলহাজ হোসেন জানান, ১৫ বছর ধরে এই সেচখালে পানি আসে না। ভবিষ্যতে খাল চালু হলে তিনি সেচখাল থেকে মাটি সরিয়ে ফেলবেন।

পাউবোর বেড়া কার্যালয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ‘পাবনা সেচ প্রকল্পের অবকাঠামোর জন্য ইতিমধ্যেই একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে বন্ধ সেচখালগুলো যেমন পুনরুজ্জীবিত হবে, তেমনি নতুন নতুন এলাকায় সেচখালও নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে অনেকগুলো সেচখাল সংস্কার করে সেচের আওতা বাড়ানো হয়েছে।’