নাচগানসহ নানা আয়োজনে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী খাসিয়া (খাসি) জনগোষ্ঠীর বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ‘সেং কুটস্নেম’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সকালে উপজেলার মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি মাঠে এ উৎসবের আয়োজন করে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল। এতে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকার খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকজন এসে অংশ নেন।
খাসিয়া বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এবার ১২৫তম বর্ষকে বিদায় ও ১২৬তম বর্ষকে বরণ করে নিল খাসিয়া জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ২৩ নভেম্বর খাসি বর্ষবিদায় ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ পালন করা হয়। দিনটি খাসিয়া সম্প্রদায়ের জন্য খুবই আনন্দের। অনুষ্ঠান দেখতে বাইরে থেকেও অনেক অতিথি ও পর্যটক আসেন।
অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে দেখা যায়, খাসিয়াপুঞ্জি মাঠের মাঝখানে একটি বড় বাঁশ পোতা। সেই বাঁশে দড়ি ও কাগজের টুকরা লাগিয়ে পুরো মাঠ সাজানো হয়েছে। মাঠের চারপাশে বাঁশ, কলাপাতা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ছোট ছোট দোকান। মাঠের এক পাশে তৈলাক্ত বাঁশের খুঁটির ঠিক ওপরে রাখা হয়েছে একটি মুঠোফোন। নিচ থেকে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছেন অনেকে। অনেক চেষ্টার পর একজন বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠে ফোনটি জিতে নেন। আরেক পাশে তির–ধনুক নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে তির ছুড়ছেন কয়েকজন তরুণ। কেউ আবার গুলতি দিয়ে সামনে রাখা লক্ষ্যে ছুড়ে মারছেন। নারীরা এসব প্রতিযোগিতায় নেই। তাঁরা ব্যস্ত পান গুছানোর প্রতিযোগিতায়। মাঠের মধ্যে রাখা পানগুলো কার থেকে কে কত কম সময়ে গোছাতে পারেন, সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তাঁরা।
খাসিয়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘সেং কুটস্নেম’ বা বর্ষবিদায় খাসিয়াদের সর্বজনীন একটি উৎসব। প্রতিবছরের মতো এবারও কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া পুঞ্জির খেলার মাঠে নানা সমাহারে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ দিন বর্ষবিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় তারা।
বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে খাসিয়ারা তাঁদের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে আদি পাহাড়ি নৃত্য ও গান করেন। পাশাপাশি তাঁদের জীবিকার প্রধান উৎসব জুমচাষের ও জীবন-জীবিকার বিভিন্ন পদ্ধতি নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
এদিকে উৎসব উপলক্ষে সকাল থেকে মাগুরছড়া পুঞ্জির মাঠে বসে ঐতিহ্যবাহী মেলা। মেলায় খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসেন বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে। বিভিন্ন স্টলে খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, পান, তির, ধনুকসহ বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়। খাসিয়া সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির বাসিন্দা হেলোনা বলেন, ‘খাসি জনগোষ্ঠীর জন্য উৎসবটি অনেক আনন্দের। আমরা এই উৎসবের অপেক্ষায় থাকি। উৎসবে আমাদের জনগোষ্ঠীর লোকজন একত্র হই। সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়। আমরা অনেক আনন্দ করি।’
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ও উৎসব আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক ফিলা পতমি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাসি সেং কুটস্নেম বাংলায় করলে হবে খাসি বর্ষবিদায়। ১৮৯৯ সাল থেকে খাসি জনগোষ্ঠীর লোকজন এ অনুষ্ঠান করলেও বাংলাদেশে আমরা ২০১১ সাল থেকে আয়োজন করছি। ব্রিটিশ আগ্রাসনে যখন আদিবাসীদের ভাষা সংস্কৃতি হুমকির মধ্যে পড়েছিল, তখন কিছু খাসি তরুণ মিলে এই উদ্যোগ নিয়ে সেং খাসি নামে একটি সংগঠন করেছিলেন। সেই দিনটি ছিল ২৩ নভেম্বর। সেই থেকে দিনটি আমরা পালন করছি।’
ফিলা পতমি আরও বলেন, খাসিদের আয়ের উৎস পান চাষ ও ব্যবসা। এবার ব্যবসা মন্দা চলছে। আর্থিক সংকটের কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। পরে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ফোন পান। কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার আশ্বাস পান। পরে তাদের সহযোগিতায় অনুষ্ঠানটি করতে পেরেছেন। সর্বাত্মক সহযোগিতা করায় তাঁরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।