বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর মেজ ছেলে সেরনিয়াবাত মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহকে ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর আজ শনিবার বরিশালের আদালতে হাজির করার কথা থাকলেও, তা হচ্ছে না। দুপুরে ঢাকার পল্টন থানা যুবদল নেতা শামীম হত্যা হত্যা মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাঁর ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে বরিশালেও দুটি মামলা রয়েছে। এ জন্য তাঁকে বরিশালের আদালতে হাজিরের সম্ভাবনা নিয়ে এলাকায় দিনভর আলোচনা ছিল। বরিশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (কোতোয়ালি) জিআরও এনামুল হক সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় শামীম হত্যা মামলায় মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহর ৫ দিন রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। রিমান্ড শেষ হলে আমরা তাঁকে বরিশালের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বরিশালে আনব।’
মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহকে বরিশালের রাজনীতিতে খুব একটা দেখা যায়নি। তাঁর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির ১ নম্বর সদস্য। হাসানাত আবদুল্লাহ শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সাড়ে ১৫ বছরে বরিশাল জেলা ও মহানগর এবং বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলার রাজনীতি ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। শুধু রাজনীতি নয়, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের দলীয় মনোনয়ন থেকে শুরু করে দলীয় পদ–পদবি পেতে হলে হাসানাত আবদুল্লাহর আশীর্বাদ প্রয়োজন হতো। একই সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, সরকারি চাকরির বদলি থেকে শুরু করে সব কিছুর একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন হাসানাত। এ ছাড়া এলাকায় বিভিন্ন লোকজনের জমি দখলসহ নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এই নেতার বিরুদ্ধে।
আবুল হাসানাতের তিন ছেলের মধ্যে মঈন মেজ। বড় ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। সাদিক বরিশালে বাবার রাজনীতি দেখভাল করতেন। ছোট ছেলে আশিক আবদুল্লাহ নিজ এলাকা আগৈলঝাড়া-গৌরনদীতে বাবার রাজনীতি ও অন্যান্য সব কিছু দেখভাল করতেন। আশিক আবদুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদে থাকলেও মঈন আবদুল্লাহর স্থানীয় কোনো কমিটিতে পদ ছিল না। তিনি ছিলেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক।
দলীয় সূত্র জানায়, মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ মূলত ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তৈরি পোশাক কারখানা, আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা আছে তাঁর। বরিশালে তিনি রাজনীতিতে কখনো তেমনভাবে জড়াননি। তবে ২০১৮ সালে সিটি নির্বাচনে বড় ভাই সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র প্রার্থী হলে মঈন দীর্ঘদিন বরিশালে অবস্থান করে ভাইয়ের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেন। এ ছাড়া প্রায়ই তিনি বরিশালে আসতেন এবং দু-চার দিন করে অবস্থান করতেন। বরিশালে এলে দলীয় ক্যাডারদের বড় একটি অংশ সব সময় তাঁকে অনুসরণ করত এবং তিনি যেখানে যেতেন, সঙ্গে থাকত।
দলের একটি সূত্র জানায়, বরিশালের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও মঈন বরিশালে তাঁর একটি সমর্থক বাহিনী তৈরি করেছিলেন, যাঁরা বরিশালে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে মঈনের বিরুদ্ধে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও গত সাড়ে ১৫ বছরে এ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়নি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বরিশাল নগরের কালীবাড়ী সড়কে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের (মঈন আবদুল্লাহর দাদা) বাড়িতে আগুন দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এতে ওই বাড়িতে অবস্থান করা নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সিটি কাউন্সিলর নঈমুল হোসেনসহ তিন নেতা-কর্মী আগুনে পুড়ে মারা যান। এই বাড়িতে মঈনের বড় ভাই সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ পরিবার নিয়ে থাকতেন। বিক্ষুব্ধ জনতা গত ৫ আগস্ট ওই বাড়িতে হামলা চালানোর সময় সাদিক ও তাঁর পরিবার ওই বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। পড়ে বাড়ির পেছনের গেট থেকে তিনি তাঁর সমর্থক ও পরিবার নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান।
পরে ১৩ আগস্ট দুপুরে আকস্মিক বরিশালে আসেন মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ। ওই দিন প্রথমে তিনি নগরের কাউনিয়া এলাকায় নানাবাড়িতে যাওয়ার পাশাপাশি নগরের কালীবাড়ী সড়কের পৈতৃক বাড়িতেও যান। তবে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেননি তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও দলীয় সূত্রে জানা যায়, ১৩ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে মঈন আবদুল্লাহ একটি কালো রঙের গাড়িতে নগরের কাউনিয়া এলাকায় তাঁর নানাবাড়িতে আসেন। গাড়িটি তিনি নিজেই চালাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের ছেলে মুয়াজ আরিফ। গাড়িবহরে ছিল আরও দুটি সাদা রঙের প্রাইভেট কার ও তিনটি মোটরসাইকেল। নানাবাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে নগরের কালীবাড়ী সড়কে পৈতৃক বাড়িতে আসেন মঈন আবদুল্লাহ। পৈতৃক বাড়ির সামনে এসে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন তিনি। পরে নগরের মুসলিম গোরস্থান রোডে তাঁর মা বেগম শাহানারা আবদুল্লাহ ও আগুনে পুড়ে নিহত কাউন্সিলর নঈমুল হোসেনের কবর জিয়ারত করেন। পরে তিনি ঢাকায় ফিরে যান।
পুলিশ জানায়, মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে বরিশাল কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা রয়েছে। একটি মামলার বাদী বরিশাল নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান এবং অপরটির বাদী নগর বিএনপির সদস্যসচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট দুপুরে নগরের সদর রোডে বিএনপি কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নগর বিএনপির আহ্বায়ক গত ২৩ আগস্ট একটি মামলা করেন। মামলায় ৩৮১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। কোতোয়ালি মডেল থানার ওই মামলায় মঈন উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় মামলাটি হয় গত ২১ অক্টোবর একই থানায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বিকেলে নগরের সিঅ্যান্ডবি রোডে বিএনপির মিছিলে হামলার অভিযোগে এই মামলা করেন নগর বিএনপির সদস্যসচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। গত ২১ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় করা ওই মামলাতেও মঈন আসামি। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫০৪ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের দুজন নেতা আজ দুপুরে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও তাঁকে এই দুই মামলায় শুধু আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে হওয়ায় আসামি করা হয়েছে। সারা দেশে দলের নিরীহ-নিরপরাধ হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে একইভাবে ‘মিথ্যা’ মামলায় আসামি করে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
নগর বিএনপির সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার এমন অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৩ জুলাই বরিশালে বিএনপির মিছিলে হামরার সময় শটগান ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দলীয় ক্যাডারদের সঙ্গে মঈন ও সাদিক আবদুল্লাহ অংশ নিয়েছেন। একই সঙ্গে মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও তাঁর নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী ছিল, যারা গত ১৫ বছরে বরিশালে নানা সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
জিয়া উদ্দিন সিকদার আরও বলেন, ‘শুধু তা–ই নয়, বরিশালে সাদিক আবদুল্লাহর পাশে থেকে তিনি প্রক্সি দিয়েছেন, আবার যখন তাঁর বাবার সংসদীয় এলাকায় বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করার প্রয়োজন হতো, তখন মঈন ও সাদিক বরিশাল থেকে সেখানে গিয়ে প্রক্সি দিত।’
এদিকে মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহ ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। তাঁকে বরিশালে আনা হবে কি না, সেটা আমাদের এখনো কিছু জানানো হয়নি।’
এর আগে গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর গুলশান-২ এলাকা থেকে মঈন আবদুল্লাহ গ্রেপ্তার হন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা এ অভিযান চালান। পুলিশ জানায়, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি কেন্দ্রীয় মহাসমাবেশ কর্মসূচি ছিল। এই মহাসমাবেশ পণ্ড করার জন্য একই দিনে আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশ ডাকে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের হত্যা ও গুম করার উদ্দেশ্যে পুলিশের সহায়তায় বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশে হামলা চালানো হয়। এতে বিএনপির অনেক নেতা–কর্মী আহত হন। যুবদল নেতা শামীম মারা যান। এ ঘটনায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় মঈন উদ্দিন আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।