ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে এ বছর তরমুজের ভালো ফলন হয়েছে। ছবি রোববার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের বৈরাগীর চরে তোলা
ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে এ বছর তরমুজের ভালো ফলন হয়েছে। ছবি রোববার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের বৈরাগীর চরে তোলা

মেঘনার সবুজময় চরে বাহারি তরমুজ

ভোরের সূর্য মেঘনার নোনা জলে পড়ে চিকচিক করছে। পানির দিকে তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। রোববারের সকাল। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরার তাড়া এখানে নেই। ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা তালতলী ঘাট থেকে মাঝের চরের উদ্দেশে আমাদের ট্রলার ছুটল। আমি ছাড়া ট্রলারের যাত্রীরা সবাই মাঝের চরের তরমুজচাষি ও খেতমজুর। কৃষকদের কথায় জানা গেল, তরমুজের এবার ফলন ভালো হয়েছে, বাজারে দামও ভালো।

প্রায় এক ঘণ্টা ট্রলার চলার পর মাঝের চরের দেখা মিলল। ভোলাকে তিন দিক থেকে ঘিরে রাখা দুই বড় নদী মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার মধ্যে সরকারি হিসাবে ৭৪টি চর আছে। এর সব কটির আলাদা নাম থাকলেও এগুলো মাঝের চর হিসেবে পরিচিত। বর্ষায় এসব চর জোয়ারে ডুবে যায়, ভাটায় জেগে ওঠে। কোনো কোনো চরে মানুষ টংঘর তোলে, মাটির উঁচু ভিটা তুলে গবাদি পশু–পাখি পালন করে। বর্ষায় ডোবা জমির অস্তিত্ব দূর থেকে চোখে পড়ে না, কিন্তু ভাদ্র-আশ্বিনে জোয়ারের উচ্চতা কমতে শুরু করলে পলির চাদরে ঢাকা চর জেগে ওঠে। কার্তিক মাস আসতেই এসব পলি-পল্লবিত পতিত জমিতে কৃষকেরা সবজি আবাদের প্রস্তুতি নেন।

আমরা যাচ্ছি, মধুপুর ও চর বৈরাগীতে। এর পাশে আছে কানিবগা, ভোলা, মদনপুর ও বারাইপুর চর। মেঘনার মধ্যে মাইলের পর মাইল এলাকায় চর পড়েছে। ভাটার সময় শুকিয়ে যায়। লোকজন হেঁটে এক চর থেকে আরেক চরে যায়। ঘাট বলে কিছু নেই। চরের এক স্থানে আমাদের নামিয়ে দিলে, কাদা-পানি ভেঙে মূল চরে যাই। চরে নেমে দেখি, চারদিকে সবুজ আর সবুজ। শুধু ফসল। যেন সবুজের চর।

সেখানে দেখা যায়, চিচিঙ্গা, শসা-ক্ষীরা, বেগুন-টমেটো, ঝিঙে, লাফা-বরবটি, ধুন্দুল, কুমড়া, লাউ, নানা রকম মরিচ, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ-রসুন, বাদাম, সয়াবিন, ধনে, ডাঁটা আর তরমুজ। কী নেই চরে! কলাই, গম, সবজির খেত ডিঙিয়ে তরমুজের খেতে এসে দেখি, চরের দক্ষিণ পাশটায় একরের পর একরজুড়ে তরমুজ আর তরমুজ। বাহারি আকারের তরমুজ। ডোরাকাটা, কালচে, সবুজাভ গোলাকার, লম্বাটে। ওজন ৩ থেকে ১৩ কেজি। শ্রমিকেরা তরমুজ কেটে ট্রলারে তুলছেন। সেই ট্রলার যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।

মধুপুর ও বৈরাগীর চরে আবুল হাসান কেরানি, আবু বকর, মো. আনিস, হাজি আ. মান্নান, নিজামউদ্দিন, সফিক মোল্লা, মঞ্জুর মিঞাজি, শাহিন মাস্টার, আলী হোসেন, আলাউদ্দিন, আবদুর রাজ্জাকসহ ৫৪ জন কৃষক প্রায় ৮০০ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন।

কৃষক মো. শাহাবুদ্দিন ফরাজি বলেন, এ বছর তিনি প্রায় ২০ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলের আকার ভালো। তবে মিষ্টিপানি পেলে আরও ভালো হতো। শাহাবুদ্দিন রোববারই প্রথম দুই হাজার তরমুজ কেটেছেন। যেগুলো কেটেছেন, সেগুলোর আকার ৭ কেজি থেকে ১৩ কেজি। এ তরমুজ তিনি ফেনীতে বিক্রি করবেন।

শাহাবুদ্দিন ফরাজি বলেন, এ বছর এক একর জমি থেকে কমপক্ষে দেড় হাজার মানসম্পন্ন তরমুজ পাওয়া যাবে। ঢাকার আড়তে ১০০ তরমুজ ৩৫ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। যদিও এসব তরমুজের আকার ১২-১৫ কেজি। তবে ভোলার বাজারে ৫-৬ কেজির তরমুজের ১০০টি বিক্রি হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা।

এ বছর ভোলার ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর (৪৫ হাজার ৪০৬ একর) জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। ছবি রোববার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের বৈরাগীর চরে তোলা

ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামারবাড়ি সূত্র জানায়, এ বছর জেলার ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর (৪৫ হাজার ৪০৬ একর) জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে ৫৩ মেট্রিক টন; যা বাম্পার ফলন। এক কেজি ৫০ টাকা দরে বিক্রি হলে প্রায় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে।

তবে কৃষকদের হিসাবে তাঁরা খেতে বসে দাম পাবেন প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কৃষকদের ভাষ্য, আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে এবার তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে সত্য, কিন্তু মেঘনার মধ্যে জেগে ওঠা চরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ ও সেচব্যবস্থা না থাকায় কৃষকের খরচ বেশি হওয়াসহ বারবার ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে।

দৌলতখান উপজেলার মদনপুরের কৃষক নিজামউদ্দিন জানান, এ বছর তিনি পাঁচ একর জমিতে সবজির আবাদ করেছেন। ১৫ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন। সবজি ও তরমুজের ফলন ভালো হলেও মৌসুমের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে তাঁর মতো অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তরমুজচাষিরা জানান, এ বছর তরমুজখেতে জাবপোকা আক্রমণ করায় কৃষকের কীটনাশক বাবদ খরচ বেশি হয়েছে। ওষুধ কোম্পানি ভেজাল ওষুধ দেওয়ায় পরিমাণেও বেশি লেগেছে।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ এফ এম শাহাবুদ্দিন বলেন, কৃষকেরা কীটনাশক ব্যবহারের নিয়ম, মাত্রা কিছুই মানেন না। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ, বোতলের গায়ে লেখা নিয়ম উপেক্ষা করে বেশি অথবা কম ব্যবহার করছেন। এ কারণে উপকারী পোকা মারা যায় এবং ক্ষতিকারক পোকার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে যায়। পরাগায়নেও সমস্যা হয়।

ভোলা জেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান ওয়ারেসুল কবির বলেন, ‘পরাগায়নের সমস্যা ও জাবপোকার আক্রমণে তরমুজের কিছু ক্ষতির পরেও ভোলায় বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করি, কৃষকেরা লাভে থাকবেন।’