বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এর দক্ষিণে বিচ্ছিন্ন আরেক দ্বীপ ছেঁড়াদিয়া। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর প্রায় দুই একর আয়তনের ছেঁড়াদিয়াসহ পুরো সেন্ট মার্টিনকে সরকার প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছিল ১৯৯৫ সালে। তবে মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে নীল জলরাশিতে ঘেরা এই দ্বীপের প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি। ২০২১ সালেও ছেঁড়াদিয়া-সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেন অন্তত ১৫ লাখ পর্যটক।
দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে লোকসমাগম সীমিত করার উদ্যোগ নেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তর। ২০২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর মধ্যে ছেঁড়াদিয়ায় ভ্রমণনিষিদ্ধ ও ট্রলারের চলাচল বন্ধ করা হয়। ছেঁড়াদিয়া দেখভালের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনী।
শনিবার থেকে ছেঁড়াদিয়াতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু করে কোস্টগার্ড বাহিনী। পাঁচ হাজারের মতো গাছ লাগানো হবে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নারকেল ও কেয়াগাছ। অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ কাঠবাদাম, হরীতকী ও ঔষধি গাছ।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য, এ দ্বীপে ছিল ১৫৪ প্রজাতির শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৯১ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৩৪ প্রজাতির মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ। বিচরণ ছিল ৭৭ প্রজাতির পাখি, ৩৩ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি ও ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। যদিও মানুষের নিষ্ঠুরতায় প্রবাল-শৈবালসহ অনেক প্রজাতি হারিয়ে গেছে।
ছেঁড়াদিয়ায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি তত্ত্বাবধান করছেন কোস্টগার্ড বাহিনীর কমান্ডার ফরহাদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিনের এই কর্মসূচিতে প্রায় পাঁচ হাজার বিভিন্ন জাতের চারা রোপণ হচ্ছে। গত বছরও নানা জাতের চারা রোপণ করা হয়েছিল।
সেন্ট মার্টিন ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ নোমানসহ ২৮ জন স্বেচ্ছাসেবী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। মোহাম্মদ নোমান প্রথম আলোকে বলেন, লঘুচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর প্রচণ্ড উত্তাল। গত ১০-১২ দিনের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব দিকের সৈকতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। নারকেলগাছ, ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে। ধসের ঝুঁকিতে পড়েছে শতাধিক হোটেল রিসোর্টসহ নানা স্থাপনা। অথচ বিচ্ছিন্ন ছেঁড়াদিয়ার চেহারা অন্য রকম, সেখানে বালিয়াড়ি সৃষ্টির মাধ্যমে দ্বীপের আয়তন আরও বড় হচ্ছে। কয়েক বছর গাছগুলো সংরক্ষণ করা গেলে ছেঁড়াদিয়া আগের মতো হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত মৌসুমে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) দৈনিক ১৫ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেছেন। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। তাই দ্বীপের সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আগামী মৌসুম থেকে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) সেন্ট মার্টিনে লোকসমাগম সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তখন অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে দিনে সর্বোচ্চ ৯০০ জন ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু এক হাজার টাকা কর পরিশোধ করতে হবে। সেন্ট মার্টিনে রাতে থাকলে গুনতে হবে ২ হাজার টাকা। দ্বীপে রাতযাপনের জন্য হোটেল-রিসোর্ট আছে ১১৬টির বেশি।
ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, সরকার যে ১৪ বিধিনিষেধ দিয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে দ্বীপের চেহারা পাল্টে যাবে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, হোটেলের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে সেন্ট মার্টিনের স্বচ্ছ নীল জলরাশি। দ্বীপের ১১৬টি হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজের কোনোটিতে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) নেই। দ্বীপের কোথাও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বালাই নেই। সব ধরনের বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা ছড়াচ্ছে সমুদ্রে। প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে মরছে সামুদ্রিক কচ্ছপ, ডলফিনসহ নানা প্রাণী।