কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ৫, সবাই একই পরিবারের

রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে লণ্ডভণ্ড বসতঘর। মঙ্গলবার সকালে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন কালিন্দী গদারবাগ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার কেরানীগঞ্জের কালিন্দী গদারবাগে আবাসিক এলাকায় থাকা রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ আরেকজন মারা গেছেন। আজ মঙ্গলবার বেলা একটার দিকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

নিহত সোহাগ মিয়া (৩০) গদারবাগ এলাকার হানিফ মিয়ার ছেলে। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মারা যান সোহাগের স্ত্রী মিনা আক্তার (২০) ও দেড় বছর বয়সী মেয়ে তাইয়েবা আক্তার।

এ ঘটনায় আজ বিকেল পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে। অপর নিহতরা হলেন সোহাগের বড় ভাই সৌদিপ্রবাসী মিলন মিয়ার স্ত্রী জেসমিন আক্তার (৩২) ও তাঁর মেয়ে ইশা আক্তার (১৪)। নিহত সোহাগের দগ্ধ আরেক মেয়ে তানহা আক্তার (৪) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।

পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সোহাগ ও মিলনের বাবা হানিফ মিয়া (৫৫)। কথা বলতে গিয়ে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি। হানিফ বলেন, ‘অহন আমি কাগো নিয়া বাঁচুম? আমার মতো এই মর্মান্তিক ঘটনা যেনো আর কারো ভাগ্যে না জুটে। আরেক নাতনি তানহা হাসপাতালে ভর্তি। তারও অবস্থা বেশি ভালো না।’

সরেজমিনে দেখা যায়, গুদাম থেকে তিন গজ দূরত্বে চারটি আধা পাকা ঘর। ঘরগুলোয় তিনটি পরিবারে বসবাস। আর রাসায়নিকের গুদামটি টিনশেডের। স্থানীয় লোকজন জানান, গতকাল ভোরের দিকে গুদামে বিস্ফোরণে পাশের ঘরগুলোতেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ঘটনাস্থলেই চারজন মারা যান। আহত হন আরও দুজন। স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘরের দেয়াল ভেঙে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করেন।

বিস্ফোরণে গুদামের অর্ধেকের বেশি অংশ দুমড়েমুচড়ে গেছে। ভেতরে রাসায়নিক দ্রব্য ও পদার্থ গলে মেঝেতে পড়ে আছে। সেগুলোর দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এর পাশে কয়েক শতাধিক পোড়া বস্তা পড়ে আছে। গুদামের তিন থেকে চারটি আধাপাকা ঘরেও রাসায়নিক দ্রব্য ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের বেশির ভাগ আসবাবপত্র ও মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বিস্ফোরণে ঘরের সিলিং ফ্যান পর্যন্ত দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে। বাড়ির কক্ষের বারান্দায় থাকা একটি মোটরসাইকেলের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় গুদামটি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা এলাকার রাসায়নিক ব্যবসায়ী টুটুল মিয়ার মালিকানাধীন। পাশের ঘরগুলোও তাঁর। এগুলো ভাড়া দেওয়া। নিহত সোহাগের প্রতিবেশী মো. হারুন বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সীমানা ঘেঁষে টুটুলের রাসায়নিকের গুদাম। তাঁর দোকানের কর্মচারী সোহাগ পরিবার পরিজন নিয়ে টুটুলের বাড়িতেই বসবাস করতেন।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হারুণ বলেন, ‘সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমার পরিবারের সদস্যরা রাতে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ি। গভীর রাতে হঠাৎ আশপাশ বাড়ির লোকজন আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে থাকে। চিৎকার শুনে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠি। এ সময় রাসায়নিকের দুর্গন্ধে আমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সে সময় আমি স্ত্রী ও মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে দৌড়ে বাইরে চলে যাই। এর কিছুক্ষণ পর আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে আমাদের বাড়ির দুটি টিনশেডের ঘর আগুনে পুড়ে যায়।’

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কেরানীগঞ্জ স্টেশনের ওয়্যারহাউস পরিদর্শক মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ঘটনাস্থলে জুতার ও কলমের কালি জাতীয় রাসায়নিক দ্রব্য পাওয়া গেছে। আমরা আগুনের সংবাদ পাই ভোর চারটার দিকে। কিন্তু আগুন লেগেছিল দিবাগত রাত তিনটার পরে। কেরানীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস এবং পরে সদরঘাট ফায়ার সার্ভিস ও ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর থেকে প্রায় ছয়টি ইউনিট দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

মোহাম্মদ হানিফ আরও বলেন, এই রাসায়নিক গুদামের মালিকের নাম মো. টুটুল মিয়া। তিনি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা এলাকার বাসিন্দা। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এই রাসায়নিক গুদাম পরিচালনার কোনো অনুমোদন ছিল না। অবৈধভাবে টুটুল মিয়া এখানে রাসায়নিক দ্রব্য মজুত করে রেখেছিলেন, যা নিয়মবহির্ভূত।

এদিকে রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণে পাঁচজন নিহত ব্যক্তির ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। আজ মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বিস্ফোরণে নিহত পরিবারের প্রত্যেককে ২৫ হাজার ও আহত ব্যক্তিদের ১৫ হাজার টাকা করে নগদ অর্থসহায়তা প্রদান করেন।

বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কোনো অবস্থাতেই আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক, দাহ্য পদার্থ ও প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদামঘর গড়ে তোলা যাবে না। এ বিষয়ে হাইকোর্ট ও সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও কিছু কিছু অতি লোভী সম্পত্তির মালিক ও ব্যবসায়ী নিজেদের স্বার্থে আবাসিক এলাকায় কারখানা ও গুদামঘর পরিচালনা করে থাকেন। এটা অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ।