বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের রাজশাহীর পৈতৃক বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে পাশে থাকা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের সিসিটিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চলচ্চিত্রকর্মীরা বলছেন, বাড়ি ভাঙার ফুটেজ যাতে না দেখা যায়, এ কারণে কলেজে থাকা সিসিটিভি বন্ধ করে রাখা হয়। এ ব্যাপারে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, সিসিটিভি তারা বন্ধ করেনি।
এর আগে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার খবর পেয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে জড়ো হন রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা। এ সময় কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলচ্চিত্রকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে ঠিকাদার দাবি করেছেন। তবে কলেজের অধ্যক্ষ বলছেন, তাঁদের সাবেক শিক্ষার্থীরা এটা ভেঙে ফেলেছেন।
স্থানীয় সূত্র ও চলচ্চিত্রকর্মীরা বলেন, গতকাল ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙার খবর পেয়ে তাঁরা নগরের মিয়াপাড়া এলাকায় জড়ো হন। সেখান থেকে সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে তাঁরা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে যান।
সেখানে দেখতে পান, গত ৬ আগস্ট দুপুর ১২টা ৪৪ মিনিট পর্যন্ত কলেজের সিসিটিভি চলছিল। এর পর থেকে সিসিটিভি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো ফুটেজ ধারণ হয়নি। তাঁদের অভিযোগ, এই ভাঙচুরে কলেজ প্রশাসন রয়েছে।
সিসিটিভি বন্ধ হওয়ার বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, ‘এর আগেও সিসিটিভি বন্ধ হয়ে গেছে। এটা নতুন কিছু না। এটা আমরা বন্ধ করিনি। আমি এটা খুব বেশি বুঝিও না। ওই দিন থেকে বাইরের সাইটের তিনটি ক্যামেরা মিসিং আছে। ওই দিন যাঁরা (সাবেক শিক্ষার্থী) এসেছিলেন, তাঁরা এটা করেছেন কি না, তা–ও বলতে পারছি না।’
এদিকে রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ গতকালই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. মহিনুল হাসানকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তিনি আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। সিসিটিভি ফুটেজ তিনিও ওই দিন পর্যন্তই পেয়েছেন। তিনি আজ ঋত্বিক ঘটকের বাড়িতে এসে চলচ্চিত্রকর্মী ও কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাড়ি পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, তিনি খুব দ্রুত এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। এই কাজ করেছে যারা, সেই দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। খুব দ্রুতই এখানে সবাইকে নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের নামে দৃশ্যমান কিছু করবে জেলা প্রশাসন।
আজকেও ঋত্বিক ঘটকের বাড়িতে এসেছিলেন চলচ্চিত্রনির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম সাইক। তিনি বলেন, আগামী ৪ নভেম্বর ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে উৎসব করা হবে। সে ক্ষেত্রে এখানে দ্রুতই একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, অফিস কাম লাইব্রেরি করে দেবে জেলা প্রশাসন। পরে এখানে ঋত্বিক ঘটক কমপ্লেক্স করা হবে। তাঁরা আজকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই আশ্বাস পেয়েছেন। সিসিটিভি বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তো অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ হয়। উনি কিছু না করলে এটা কী করে সম্ভব যে বন্ধ হয়ে যাবে।’
ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীতে। এই বাড়িতে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ ও মিয়াপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন ঋত্বিক। তাঁকে ঘিরেই তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।
এই বাড়ির পুরো ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়। কলেজটি বাড়ি ঘেঁষেই পশ্চিম পাশে রয়েছে। ২০১৯ সালে বাড়িটির একাংশ ভেঙে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির অভিযোগ উঠেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তখন রাজশাহীসহ সারা দেশে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়। পরে ২০২০ সালে বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় রাজশাহী জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন থেকে পরে ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি ইজারা থেকে অবমুক্ত করে ঋত্বিক ঘটকের নামে দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছিল।