চারপাশের দেয়ালজুড়ে সাঁটানো বহু পুরোনো কুপিবাতি, শতবর্ষী সারিন্দা (লোকবাদ্যযন্ত্র) আর ব্রিটিশ আমলের জাহাজ। আছে রেলে ব্যবহৃত কেরোসিনের সিগন্যাল বাতিও। টেবিল আর সেলফের তাকে তাকে সাজানো শত বছরের পুরোনো পানবাটা, কাঠের সিন্দুক, শতবর্ষী বই-পত্রিকা-চিঠি, তুলট কাগজ, তালপাতার পুঁথি ও দোয়াত। রয়েছে হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরিফ, জমিদারি দলিল-দস্তাবেজ, অসংখ্য ধাতব মুদ্রা আর ডাকটিকিট।
শিশির চন্দ্র নাথের সংগ্রহে এখন অন্তত এক হাজার সামগ্রী আছে। এর বাইরে রয়েছে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকী, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের দলিল-দস্তাবেজ, শতবর্ষী চিঠি-পোস্টকার্ড আর বইপুস্তক।
এমন সব বিচিত্র সামগ্রীর সংগ্রাহক সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার লামা গঙ্গাপুর গ্রামের যুবক শিশির চন্দ্র নাথ, যা দিয়ে তিনি নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন সমৃদ্ধ এক সংগ্রহশালা। অন্তত এক হাজার পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এসব সামগ্রীর কোনো কোনোটির বয়স ১০০ থেকে ১৫০ বছর। শিশির উপজেলার বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
শিশিরের বাড়িকে ‘প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সামগ্রীর দুর্লভ সংগ্রহশালা’ বলেই মানেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিক উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশির একজন ভালো শিক্ষক। পাশাপাশি ঐতিহ্য ও ইতিহাস-সচেতন ব্যক্তি। দেশের বহু পুরোনো দুর্লভ ও প্রাচীন সামগ্রী এবং দলিল-দস্তাবেজ তিনি সংগ্রহ করছেন। তরুণ প্রজন্ম এ সংগ্রহশালা পরিদর্শন করে ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাবে।
২০১৩ সালের ঘটনা। শিশির তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) পড়ছেন। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি এসে দেখেন, পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে প্রচলিত কিছু ধাতব মুদ্রা পুঁটলিতে বেঁধে সংগ্রহ করে রেখেছেন তাঁর দাদি। ছুটি শেষে সেসব নিয়ে তিনি ঢাকায় ফেরেন। এরপর বাংলাদেশ আমলে প্রচলিত সব মুদ্রা সংগ্রহের নেশা তাঁকে চেপে ধরে। ধীরে ধীরে সংগ্রহও করে ফেলেন। পরে যেখানেই পুরোনো, দুর্লভ ও প্রাচীনসামগ্রী কিংবা বই-পুঁথি-চিঠি-দলিল-কাগজপত্র পেয়েছেন, সেসব সংগ্রহ করা শুরু করেন।
শিশির চন্দ্র নাথের সংগ্রহে এখন অন্তত এক হাজার সামগ্রী আছে। এর বাইরে রয়েছে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকী, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের দলিল-দস্তাবেজ, শতবর্ষী চিঠি-পোস্টকার্ড আর বইপুস্তক। শিশির জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি টিউশনি করতেন। সেই আয় দিয়ে নিজের খরচ মেটানোর পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন পুরোনো জিনিসপত্র বেচাকেনার দোকানে গিয়ে প্রাচীন ও দুর্লভ সামগ্রী কিনতেন। একসময় নিজের মেসের কক্ষটি সংগ্রহশালায় পরিণত হয়।
শিশির চন্দ্র বলেন, ঢাকা শহরে বড় পরিসরে সংগ্রহশালা তৈরি করা বাস্তবতার নিরিখেই অসম্ভব ব্যাপার। স্থানসংকুলানের কারণে বিষয়টি ক্রমে বোঝা হয়ে পড়ছিল। এ কারণে গ্রামে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। অন্য কোনো চাকরির পরীক্ষা না দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সংগ্রহশালাটা নিজের মতো করে প্রস্তুত করার জন্য। এখন শিক্ষকতা শেষে বাকি সময়টুকু সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করতেই কাটে।
শিশির বলেন, ‘কোথাও দুষ্প্রাপ্য জিনিস অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে দেখলে তা সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। কখনো টাকা দিয়ে কিনি, আবার অনেকে আমার আগ্রহ দেখে উপহারও দেন। কোথাও ঘুরতে গেলে কিছু না কিছু সংগ্রহের চেষ্টা করি। সংগ্রহ করতে গিয়েই দেশের বিভিন্ন সংগ্রাহক ও গবেষকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের মারফতও অনেক কিছু সংগ্রহ করি।’
সম্প্রতি ফেঞ্চুগঞ্জের লামা গঙ্গাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শিশিরের বাড়ির তিনটি কক্ষে তাঁর সংগ্রহের জিনিসপত্র রাখা। এর মধ্যে ড্রয়িংরুমে একটা ট্রাঙ্কে দুটি পলিথিন দিয়ে সযত্নে মুড়িয়ে রাখা রয়েছে ১৯১০ ও ১৯২৬ সালে লেখা দুটি চিঠি। ১৮৮০ সালে চামড়ার কাগজে লেখা একটি চালানপত্র, জমির প্রাচীন দলিল এবং ১৯২৩, ১৯৩৯ ও ১৯৪২ সালের খাজনা আদায়ের রসিদও একই ট্রাঙ্কে সংরক্ষিত। আছে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সময়ের ১ পাই সিকি আর গান্ধার (বর্তমানে আফগানিস্তান) জনপদের প্রাচীন মুদ্রা ও হাতির হাড় দিয়ে তৈরি গয়নার বাক্স।
পিতলের তৈরি একটি ক্যালেন্ডার দেখিয়ে শিশির চন্দ্র বলেন, ১৯৯৫ থেকে ২০৯৪ সাল পর্যন্ত ৯৯ বছর এ ক্যালেন্ডারের সহায়তায় তারিখ-বার জানা সম্ভব। এ ছাড়া তাঁর সংগ্রহে হাতির দাঁতের তৈরি ঘোড়া, মহিষের শিং দিয়ে তৈরি খেলনা হাতি ও বাঘ, রানিদের ব্যবহৃত দৃষ্টিনন্দন বহু পুরোনো পিতল দিয়ে তৈরি সিঁদুর ও চুন রাখার কৌটা, শঙ্খ দিয়ে তৈরি সিঁদুরের কৌটা, ৬০ বছরের পুরোনো বেশ কিছু পিতলের সিল, চিঠি পরিবহনের পাত্র আর মেডিটেশন বোল রয়েছে।
আরও আছে তালপাতার পুঁথি, তুলট কাগজে (শণ, তুলা, তিসির তন্তু, ছেঁড়া কাপড় দিয়ে তৈরি কাগজ) লেখা পুঁথি, শতবর্ষী অসংখ্য চিঠি-পোস্টকার্ড, জমিদারি খাজনা আদায়ের রসিদ, ব্রিটিশ আমলের জমিদারি দলিল-দস্তাবেজ, বিষয়ভিত্তিক প্রায় ৫০০ ডাকটিকিট, প্রাচীন ভারতের মুদ্রা থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের সব কটি ধাতব মুদ্রা এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের অটোগ্রাফ উল্লেখযোগ্য।
শিশির চন্দ্র জানান, কলের গান, বহু পুরোনো বেশ কয়েকটি টেপরেকর্ডার ও রেডিও, ফিতার ক্যাসেট, বিভিন্ন ধরনের রিলের ক্যামেরা, নানা ধরনের হুক্কা, গ্রামোফোন রেকর্ড, বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত ২০ ধরনের দোয়াত, ৩০ ধরনের কুপিবাতি, কোরোসিন বাতি ও হ্যাজাক, জাঁতা, কয়লাচালিত ইস্ত্রি, জমিদারবাড়িতে ব্যবহৃত কাজলদানি, সুরমাদানি, পিকদানি ও পাথরের বাসন, পুরোনো টেলিফোন, খড়ম, ১২০ বছরের পুরোনো ঢেঁকি, কাঠের সিন্দুক, যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢাল, ঝরনা কলম, সুলেখা কালিসহ বিভিন্ন জিনিস তাঁর সংগ্রহে আছে।
অ্যাডওয়ার্ড ক্লড রচিত দ্য স্টোরি অব প্রিমিটিভ ম্যান (প্রাচীন মানুষের গল্প) নামের বইটি লন্ডন থেকে ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। দুই বছর আগে এ বইয়ের একটি মূল কপি শিশির চন্দ্র নাথ ঢাকার পুরোনো বই বেচাকেনার একটি দোকান থেকে কেনেন। তাঁর সংগ্রহে কলকাতার বটতলা থেকে ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত পুরোনো বাংলা পুঁথি ছহি কাছাছল আম্বিয়াও আছে।
শিশির জানান, প্রাচীন ও ঐতিহাসিক অনেক বই ছাড়াও তাঁর সংগ্রহে অসংখ্য শতবর্ষী সাহিত্য সাময়িকী, ৫০টি পুঁথি রয়েছে। তাঁর সংগ্রহে থাকা পত্রিকার মধ্যে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সওগাত, ভারতী, মোহাম্মদী, লাঙল, চতুরঙ্গ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের আগস্টে প্রকাশিত রক্তাক্ত বাংলাসহ মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশিত অনেক পত্র-পত্রিকার মূল কপি, আলোকচিত্র, পোস্টার, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রেকর্ড তাঁর সংগ্রহে আছে।
এ ছাড়া শিশিরের সংগ্রহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪৩-৪৪ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পাঠ্য ফেরদৌসী-চরিত, ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত পুঁথি ছয়ফুলমুল্লক ও বদিওজ্জামাল, পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন প্রকাশিত কৃষি-পঞ্জিকা, ইস্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড প্রকাশিত কচি কথা বোধিকা, পাকিস্তানের ইতিহাসসহ প্রাচীন মুদ্রিত বই, পুস্তিকা ও পুঁথি আছে।
যৌথ পরিবারে বাস শিশির চন্দ্র নাথের (৩২)। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। মেজো ভাইও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ছোট ভাই এখনো পড়াশোনা করছেন। তাঁদের মা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বাবা শশাঙ্ক কুমার নাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। শিশিরের স্ত্রী দীপা রানী নাথ গৃহিণী। শিশির-দীপা দম্পতি একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছেন সংস্কৃতি নাথ স্বাধীনতা।
শিশির চন্দ্র নাথ বলেন, ‘নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলতে চাই ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিচর্চার উদ্যান। সে লক্ষ্যেই এখন কাজ করছি। আমি স্বপ্ন দেখি, আমার এ সংগ্রহশালা একদিন সাধারণজনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। তখন সবাই এখানে এসে বিনা পয়সার সংগ্রহশালা পরিদর্শন করে ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেনার পাঠ নেবে।’