বরিশাল-৫ (সদর-মহানগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা চূড়ান্তভাবে আটকে গেছে আপিল বিভাগে। এর ফলে এবারের নির্বাচনে তাঁর আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নেই। প্রার্থিতা আটকে যাওয়ায় সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থকদের মধ্যে তীব্র হতাশা দেখা দিয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতার বিষয়ে চেম্বার আদালতের দেওয়া স্থগিতাদেশ চলমান থাকবে বলে মঙ্গলবার আদেশ দেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেন।
বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। কিন্তু দল গত সিটি নির্বাচনের মতো এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। মনোনয়ন পান বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন সাদিক আবদুল্লাহ।
সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, তবে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ এনে সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন বাতিল চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন জাহিদ ফারুক। অন্যদিকে জাহিদ ফারুকের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে সাদিক আবদুল্লাহও ইসিতে আপিল করেন। শুনানি শেষে ১৫ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন জাহিদ ফারুকের আপিল মঞ্জুর করে। সাদিক আবদুল্লাহর আপিল নামঞ্জুর করে।
নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নিজের প্রার্থিতা ফিরে পেতে এবং জাহিদ ফারুকের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে সাদিক আবদুল্লাহ হাইকোর্টে পৃথক দুটি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দিয়ে সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা বাতিল করে দেওয়া ইসির সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। একই সঙ্গে সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়নপত্র গ্রহণ করে তাঁকে প্রতীক বরাদ্দ দিতে নির্দেশ দেন। ফলে তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ খোলে, তবে জাহিদ ফারুকের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে সাদিক আবদুল্লাহর করা অপর রিটটি সরাসরি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেওয়া-সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন জাহিদ ফারুক। এর ওপর ১৯ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানি হয়। শুনানি নিয়ে সেদিন আদালত সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়নপত্র গ্রহণ করে তাঁকে প্রতীক বরাদ্দ দিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। এতে সাদিক আবদুল্লাহর ভোটের লড়াই আটকে যায়। এ অবস্থায় ১৯ ডিসেম্বর চেম্বার আদালতের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে সাদিক আবদুল্লাহ আবেদন করেন। এদিকে সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেওয়া-সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনও আবেদন করে। দুটি আবেদনই মঙ্গলবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে একসঙ্গে শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়। সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতার ওপর দেওয়া স্থগিতাদেশ চলমান থাকবে বলে মঙ্গলবার আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
সাদিকের প্রার্থিতা আপিল বিভাগে চূড়ান্তভাবে আটকে যাওয়ার পর তাঁর সমর্থকদের মধ্যে তীব্র হতাশা দেখা দিয়েছে। বেশ কয়েকজন সমর্থক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আশা করেছিলেন, আপিল বিভাগে সাদিক আবদুল্লাহ তাঁর প্রার্থিতা ফিরে পাবেন। এ জন্য নির্বাচনের কেন্দ্র কমিটি, পোস্টারসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিল। যেন ২ তারিখ দ্রুত প্রচার ও ভোটের প্রস্তুতি নিতে পারেন সে জন্য এমন প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগের আদেশের খবর পেয়ে তাঁরা সবাই হতাশ হয়েছেন। এই হতাশা থেকে তাঁর সমর্থকেরা আসন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে কাজ করার বিষয়েও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
গত জুনে বরিশাল সিটির নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি সাদিক আবদুল্লাহ। মনোনয়ন পেয়েছিলেন তাঁর ছোট চাচা নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। ফলে সাদিক ও তাঁর সমর্থকেরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে আবুল খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় হননি। এ নিয়ে চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর একপক্ষে অবস্থান নেন মেয়র আবুল খায়ের এবং পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক আর অপর পক্ষে সাদিক আবদুল্লাহ ও নগর আওয়ামী লীগ। এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব ও বিভেদ প্রকাশ্যে আসে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
সাদিক আবদুল্লাহ দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পর তাঁকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করে প্রকাশ্যে তাঁর পক্ষে অবস্থান নেয় নগর আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে একপক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য মঞ্চে বিরূপ মন্তব্য এবং মিছিল-সমাবেশ পর্যন্ত করেছে। কিন্তু বিভেদের সুরাহা হয়নি।
এবার স্বতন্ত্র প্রার্থিতা চূড়ান্তভাবে বাতিল হওয়ার পর সাদিক আবদুল্লাহ ও নগর আওয়ামী লীগের অবস্থান কী হবে তা জানতে সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীরের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
জাহিদ ফারুকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, বরিশাল-৫ আসনে জাহিদ ফারুক আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি যাঁরা আস্থাশীল, দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন করা ও তাঁকে বিজয়ী করতে কাজ করাটা তাঁদের সাংগঠনিক বাধ্যবাধকতার মধ্যেই পড়ে। এটা না করলে তিনি দলের কেউ বলে পরিচয় দেওয়ার নৈতিক অধিকার রাখেন না।