তিন যুগ আগের কথা! বাড়ি বাড়ি গেলে শাশুড়িরা তাঁর দিকে তেড়ে আসতেন। বাড়ির বউ-ঝিদের তাঁর সঙ্গে কথা বলতে দিতেন না। তিনি লুকিয়ে, চুরিজারি করে কথা বলতেন। পরিবার পরিকল্পনা, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিয়ে কথা বলতেন।
দিন বদলেছে। নারীরা এখন সচেতন। তাঁকে দেখলে এগিয়ে আসেন অনেকে, আগ বাড়িয়ে কথা বলেন। চান নানা পরামর্শ। তিন যুগ আগে যাঁদের পরামর্শ দিতেন, এখন তাঁদেরই সন্তানসন্ততি এমনকি নাতিদের স্বাস্থ্য পরামর্শ দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য ছাড়াও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যা নিয়ে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন তিনি।
সরকারি চাকরির বাধাধরা সময়ের বাইরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেন। অনেক সময় প্রসূতিরা তাঁর বাড়ি এসে বসে থাকেন। তখন তাঁদের নিয়ে ছুটতে হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। স্বাস্থ্য বিষয়ে নিবিড় পরামর্শ ছাড়াও দরিদ্র-অসহায় নারীদের বিপদে-আপদে এগিয়ে যান। প্রায়ই নিজে খরচাপাতি দিয়ে তাঁদের চিকিৎসা করান, ওষুধপথ্য কিনে দেন।
দরদি এই মানবসেবী মানুষটি একজন পরিবারকল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ)। এলাকাবাসীর কাছে তিনি ভরসার জায়গা, সবার প্রিয় ‘ডাক্তার আপা’। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নে ১ নম্বর ওয়ার্ডের মানুষেরা তাঁকে ওই নামেই ডাকেন। তাঁর আসল নাম রহিমা খাতুন (৫৫)। মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসার পাশাপাশি কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। চারবার সেরা স্বাস্থ্যকর্মীর পুরস্কার পেয়েছেন।
রহিমার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রহিমা খাতুন কাজের প্রতি খুবই যত্নবান। এলাকার নারীদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে তাঁর। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও সুচিকিৎসার জন্য এলাকার মানুষের কাছে ভরসার নাম রহিমা।
১৯৮৮ সালের কথা। রহিমা তখন ১৯ বছর বয়সী তরুণী। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিবারকল্যাণ সহকারী হিসেবে যোগ দেন। আলুকদিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড তখন থেকেই তাঁর কর্ম এলাকা ছিল। সে সময় ৪৫০ প্রজননক্ষম দম্পতি ছিলেন ওই এলাকায়। মাত্র ১৫-১৬ শতাংশ দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আওতায় ছিলেন। তখন একেকজন নারী পাঁচ-ছয় সন্তানের মা হতেন। রহিমার নিরলস পরিশ্রমে সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
রহিমা জানালেন, ওই এলাকায় এখন ১ হাজার ২৬০ দম্পতি আছেন। তাঁদের ৯০ ভাগই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এখন দম্পতিরা এক-দুটির বেশি বাচ্চা নেন না। তিন সন্তান আছে এমন দম্পতির সংখ্যা হাতেগোনা, বললেন রহিমা।
ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রহিমা খাতুন ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে উপজেলা পর্যায়ে এবং ২০২১ সালে জেলা পর্যায়ে সেরা স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন।
রহিমার সঙ্গে একবেলা
সপ্তাহে শুক্রবার ছুটি। কিন্তু কাজের চাপে প্রায়ই সাপ্তাহিক অবসরটুকু পান না। বাড়ি পর্যন্ত লোকজন এসে বসে থাকে। চান নানা সমাধান। এ ছাড়া সপ্তাহে দুই দিন টিকাদান কর্মসূচি, দুই দিন কমিউনিটি ক্লিনিক ও দুই দিন মাঠপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবার কাজ থাকে রহিমার।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে আলুকদিয়া ইউনিয়নের আনসার ক্যাম্পপাড়ায় একটি বাড়ির উঠান বৈঠকে ব্যস্ত দেখা গেল রহিমাকে। কয়েকজন নববিবাহিতা নারী, গর্ভবতী ও শিশুসহ প্রসূতি মা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণকারী নারীকে পাওয়া গেল সেই উঠান বৈঠকে। রহিমা এ সময় তাঁদের নাম ধরে ধরে স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছিলেন, দিচ্ছিলেন নানা পরামর্শ। কয়েকজন নারীর হাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী তুলে দিতে দেখা গেল। এরপর স্থায়ী বন্ধ্যাকরণে আগ্রহী কয়েকজন নারীকে নিয়ে রওনা দেন চুয়াডাঙ্গা শহরে মা ও শিশু মঙ্গল কেন্দ্রে।
পথ চলতে কথা হয় কয়েকজন নারীরা সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এমন কিছু রোগ আছে, যা আপনজনদের বলতেও দ্বিধা হয়। কিন্তু ‘ডাক্তার আপা’কে নির্দ্বিধায় সব খুলে বলা যায়। আর তিনি সুন্দর সমাধানও দেন। বিপদে-আপদে আপাই তাঁদের ভরসা।
গৃহিণী মিতা রানী বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীরা অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের অবহেলার শিকার হন। জরুরি প্রয়োজনে ডাক্তার আপা তাঁদের মা ও শিশু মঙ্গল কেন্দ্রে নিয়ে যান। এমনকি জেলা হাসপাতালেও নিতে হয়। অনেক সময় সন্তান প্রসবের কাজও করেন। এসব করতে গিয়ে গাড়িভাড়া, ওষুধপথ্য পর্যন্ত নিজের টাকায় কিনে দেন রহিমা।
নিজের কাজ সম্পর্কে রহিমা খাতুনের ভাষ্য, ‘চাকরি আমার কাছে ইবাদতের মতো। আমার কর্ম এলাকার উল্লেখযোগ্য পরিবারই হতদরিদ্র, নিরক্ষর মানুষ। অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ পরিবারের সদস্যদের কোনো সমস্যা দেখা দিলে অনেকেই কবিরাজি, ঝাড়ফুঁকসহ অপচিকিৎসায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জটিল পরিস্থিতিতে এমন পিছিয়ে পড়া পরিবারের নারীদের হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ প্রসূতি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করতে হয়।’
আলুকদিয়া বাজারপাড়ার বাসিন্দা রহিমা খাতুনের স্বামী আব্দুল মারুফ ব্যবসায়ী, ছেলে তানভীর সিদ্দিকী ফার্মাসিস্ট ও মেয়ে তাজনীন আক্তার আইন ও ভূমি বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
দেশে পরিবার পরিকল্পনার কাজকে আরও বেগবান করতে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি পরামর্শ দিয়েছেন রহিমা। তাঁর মতে, ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডকে দুটি ইউনিটে ভাগ করা এবং মাঠপর্যায়ে শূন্য পদে লোকবল নিয়োগ করা। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রহিমা খাতুন বলেন, চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত এমনকি অবসরের দিনগুলোতেও সেবার এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চান তিনি।