সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরী। এ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী থাকলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ শমসেরের প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে। ‘তলেতলে’ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত অনেক জনপ্রতিনিধিও কাজ করছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে গোলাপগঞ্জ উপজেলার একাধিক স্থানে শমসের মুবিন চৌধুরীর গণসংযোগের সময়ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে দেখা গেছে। তাঁর পথসভায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এক নেতা বক্তব্যও দেন। ওই নেতা শমসেরকে সোনালী আঁশ প্রতীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করার আহ্বানও জানান।
এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম নাহিদ। আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর টানা দুই দফা শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
অন্যদিকে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা শমসের মুবিন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হন। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিকল্পধারার মনোনয়নে সিলেট-৬ আসনে প্রার্থী হন। তবে নুরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, সিলেট-৬ আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ মূলত তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দলের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ (নৌকা) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেনের (ঈগল) পক্ষে দুটি পক্ষ সরব। আরেকটি পক্ষ প্রকাশ্যে সরব না থাকলেও ভেতরে-ভেতরে শমসেরের পক্ষে সক্রিয়। এর মধ্যে নৌকার মনোনয়নে গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া মঞ্জুর শাফি চৌধুরী ওরফে এলিমও আছেন।
যোগাযোগ করলে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মঞ্জুর শাফি চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তিনি তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যানের পক্ষে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেননি। তবে সিলেট-৬ আসনে কয়েকজন প্রার্থী সরব থাকায় জমজমাট ও উৎসবমুখর নির্বাচন হবে বলে তিনি ধারণা করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপ আছে শমসেরের পক্ষে মাঠে নামার জন্য। তাই দলের প্রভাবশালী কিছু নেতা আড়ালে শমসেরের পক্ষে কাজ করছেন। এ ছাড়া প্রকাশ্যেও দলটির কয়েকজন কর্মী শমসেরের পক্ষে গণসংযোগের পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ ও পথসভা করছেন। একই সঙ্গে সরওয়ারের পক্ষেও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রকাশ্যে শমসেরের পক্ষে কাজ করছেন গোলাপগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সহদপ্তর সম্পাদক মিনহাজ উদ্দিন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ও পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আশিকুর রহমান। তাঁরা জানান, বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে দলের কর্মী-সমর্থকদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই তাঁদের মতো আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী শমসেরের পক্ষে আছেন।
গতকাল বিকেল সোয়া চারটার দিকে গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমুড়া ইউনিয়নের আমনিয়া বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, শমসের মুবিন চৌধুরীর নির্বাচনী পথসভায় উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দাবি করা শফিকুর রহমান ওরফে রিপন নৌকার প্রার্থীর সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন।
সভা শেষে শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শমসের মুবিন চৌধুরীর বাড়ি গোলাপগঞ্জ। অন্য প্রার্থীদের বাড়ি বিয়ানীবাজারে। তাই উপজেলার বাসিন্দা হিসেবে আমি শমসের মুবিনের পক্ষে আছি। এ ছাড়া পাঁচ বছর আগে বর্তমান সংসদ সদস্যের পক্ষে আমি সরব ছিলাম। নির্বাচন শেষে তিনি আর কর্মীদের খবর নেননি। এ ক্ষোভেও আমি এবার ভালো মানুষের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছি।’
আমনিয়া বাজারের পথসভায় আমুড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ১৫–২০ কর্মী-সমর্থক উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মীও ওই সভায় যোগ দিয়েছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা নিশ্চিত করেন।
পথসভা শেষে শমসের মুবিন চৌধুরী লিফলেট বিতরণ করেন। এ সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পথসভা ও গণসংযোগে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়েছেন মূলত আমি গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা বলে। দলমত-নির্বিশেষে এ আসনের ভোটাররা আমার জয় দেখতে চান। তাঁরা (ভোটার) এবার কোনো দল দেখে নয়, মানুষ দেখে ভোট দেবেন। তাই সব দলমতের ভোটাররা আমার সঙ্গে আছেন।’
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যানের গণসংযোগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের থাকার বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, তলেতলে হয়তো কয়েকজন নেতা-কর্মী শমসের মুবিন চৌধুরীর পক্ষে আছেন। তবে এখানে নৌকার জনপ্রিয়তা আছে। নৌকাই জিতবে।
জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, বিএনপি পাতানো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই কোনো নেতা-কর্মী নির্বাচনে সরব নন। যদি এমনটা হয়, তাহলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দু-চারজন হয়তো একটু এদিক-সেদিক আছেন। তবে পুরো আওয়ামী লীগ পরিবারই আমার সঙ্গে আছে। সংসদ সদস্য থাকাকালে এখানে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষজন আবার আমাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন বলে আমি বিশ্বাস রাখি।’
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, সিলেট-৬ আসনে মোট প্রার্থী ছয়জন। অন্য তিন প্রার্থী হলেন জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিন (লাঙ্গল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আতাউর রহমান (ছড়ি) এবং ইসলামী ঐক্যজোটের (আইওজে) সাদিকুর রহমান (মিনার)।