যেভাবে এমটিএফই অ্যাপে প্রতারণার শিকার হলেন বরিশালের শত শত মানুষ

প্রতারণা
প্রতীকী ছবি

অনলাইন অ্যাপ এমটিএফই-এর মাধ্যমে বরিশালের অসংখ্য মানুষের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রতারিত হয়েছেন শত শত মানুষ। তবে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার আশঙ্কায় আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কিংবা এ নিয়ে তথ্য দিতে চাচ্ছেন না। ফলে ঠিক কতজনের কাছ থেকে, কী পরিমাণ অর্থ খোয়া গেছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

তবে প্রতারণার শিকার অন্তত ১১ জনের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে এই প্রতিষ্ঠানের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন অন্তত কয়েক হাজার লোক। আর অন্তত ১০ কোটি টাকা খুইয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

এই প্রতারণার ব্যাপারে বরিশালের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কোনো তথ্য নেই। প্রতারণার শিকার কেউ থানায় অভিযোগও দেননি।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমটিএফই হচ্ছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (যেমন বিট কয়েন) ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। এখানে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলানো হতো। তবে ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এমটিএফই দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান।

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা (এমএলএম) মডেলে ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিলেন। এর মধ্যে বরিশাল থেকেই যুক্ত ছিলেন হাজারের বেশি মানুষ।

বরিশালের বানারীপাড়ার বাসিন্দা ভুক্তভোগী এক যুবক বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সিইও হওয়ার ক্যাটাগরিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অধীনে ১০০ জনের বেশি যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর বিনিয়োগ ছিল ছয় লাখ টাকা। তিনি যখন লভ্যাংশের টাকা তুলতে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেন, তখনই সার্ভার আপডেট শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কেউই কোনো টাকা তুলতে পারেননি। এমন অবস্থায় তিনি তাঁর সার্কেলের সবাইকে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দেন। এরপর গত শুক্রবার রাতে হঠাৎ দেখেন প্রতিষ্ঠানটির সার্ভারই উধাও। কেউই আর তাঁদের অ্যাকাউন্টে বা প্রোফাইলে ঢুকতে পারছেন না।

তাঁর মতো আরেক ভুক্তভোগী বরিশালের শরীফ বিল্লাহ। তিনি বলেন, বরিশাল থেকে কম হলেও হাজার দেড়েক মানুষ এমটিএফইতে যুক্ত হয়েছিলেন। কম হলেও বরিশাল থেকে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, বাংলাদেশে ৪০০-এর বেশি সিইও আছেন। আরও এক হাজার জন সিইও হওয়ার তালিকায় ছিলেন দাবি করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশালের একজন সিইও বলেন, ৯৩০ ডলার বা ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৪৫ হাজার টাকা লাভ দিত প্রতিষ্ঠানটি। ৫০০ ডলার বা ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ২২ হাজার টাকা লাভ দিত। কেউ যদি ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করতেন এবং ১৫ জনকে প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করে তাঁদের ৯ হাজার ডলার বিনিয়োগে উৎসাহিত করতেন; তাহলে ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করা ব্যক্তি প্রতি মাসে অন্তত ৪ লাখ টাকা করে লাভ পাবেন এমন প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল। এভাবে শত শত মানুষ প্রলোভনে পড়ে প্রতিষ্ঠানটিতে যুক্ত হয়েছিলেন।

বরিশালের বাবুগঞ্জ থেকে এক মাস আগে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা এক যুবক বলেন, তিনি প্রতিবেশী এক বন্ধুর কথা বিশ্বাস করে এই অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রতিদিন মুনাফার টাকা বাড়ছিল। কিন্তু এক টাকাও তুলতে পারেননি, এমনকি বিনিয়োগকৃত অর্থও না। এর আগেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। লাপাত্তা হওয়ার আগে ১৫ দিন ধরে কারিগরি সমস্যার কথা বলে এই কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কমিশন বন্ধ রেখেছিল। গত শুক্রবার পুরোপুরিভাবে এমটিএফই তাদের সিস্টেম বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যায়।

বরিশালের ব্রাউনকম্পাউন্ড সড়কের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এক বন্ধুর পরামর্শে দুটি আইডি খুলে বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু কোনো অর্থ ফেরত পাইনি।’ তবে কত বিনিয়োগ করেছিলেন, তা বলতে চাননি তিনি।

মুনসি এনাম নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, প্রতারক চক্রটি তরুণ, বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন এবং মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে বিনিয়োগে উৎসাহ জোগায়।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির নাম আমাদের কাছে নেই। প্রথম শুনলাম। তবে বিষয়টি অনুসন্ধান করে যদি আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে অবশ্যই নেওয়া হবে। তবে এ ধরনের প্রতারণার ব্যাপারে ব্যক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।’