জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিভাগের ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিভাগের ফটকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে

শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে বিভাগে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমির হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হেনস্তা, ছাত্রছাত্রীদের বডি শেমিং ও নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

আজ রোববার সকাল থেকে পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের (স্নাতকোত্তর) শিক্ষার্থীরা বিভাগের ফটকে তালা ঝুলিয়ে এ বিক্ষোভ করেন। ফলে বিভাগের অন্যান্য ব্যাচের ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ ছিল।

কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ৮ সেপ্টেম্বর বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বরাবর আমির হোসেনের বিরুদ্ধে আট দফা লিখিত অভিযোগপত্র দেন তাঁরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসান পর্যন্ত গড়ায়। কয়েক দিন আগে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তবে ফলপ্রসূ কোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা পাননি। ফলে আজ সকাল থেকে তাঁরা বিক্ষোভ শুরু করেন।

ওই আট দফা অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা যেসব অভিযোগ এনেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রেজেন্টেশনের সময় ছেলেদের যথাযথ অগ্রাধিকার না দেওয়া এবং নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা; এক ব্যাচের শিক্ষার্থী নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত, এমন গুরুতর মিথ্যা তথ্য অন্য ব্যাচের ক্লাসে গিয়ে প্রচার করা; ৪৭তম ব্যাচ প্রথম বর্ষে থাকাকালীন তাঁদের একটি ব্যক্তি উদ্যোগে ভ্রমণ নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছে ও অন্য ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে গিয়ে কটূক্তি করা; ছেলেমেয়েদের নামে নিন্দনীয় কথা ছড়ানো ও তাঁদের চারিত্রিক নানা বিষয়ে প্রশ্ন তোলা; ভাইভা চলাকালে কারা ঘুরতে গিয়েছিলেন, তাঁদের তালিকা নিয়ে ভাইভা বোর্ডে থাকা শিক্ষকদের কাছে জমা দিয়ে ওই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা; ভাইভাতে পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের এ ভ্রমণটি নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করা; ক্লাসে পড়ানো বাদ দিয়ে যত অপ্রাসঙ্গিক বিষয় (যেমন গিবত করা, শিক্ষকসুলভ আচরণ না করা, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য) নিয়ে আলোচনা করা; কোনো শিক্ষার্থী তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সুপারভাইজারের অধীনে কাজ করলে এই নিয়ে ক্লাসে তাঁদের হেনস্তা করা; ক্লাসে অন্য শিক্ষকদের নামে কটূক্তি করা ও তাঁদের নানা রকম ব্যঙ্গাত্মক নামে ডাকা; শিক্ষকদের বডি শেমিং করা, শিক্ষকদের গবেষণা ও টাকাপয়সার উৎস নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা, মিথ্যাচার করা, বিভাগের সাবেক এক সভাপতি ও তাঁর ছেলেকে নিয়ে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কাছে কুৎসা রটানো ইত্যাদি।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের দাবিগুলো হলো ২০২১-২২ স্নাতকোত্তর শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা কমিটি থেকে তাঁকে অপসারণ করা; তিনি যে কোর্স পড়ান, সেটার দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে অন্য দায়িত্বশীল ও যোগ্য শিক্ষককে নিযুক্ত করা; ৪৭তম ব্যাচের কোনো কোর্সের দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষক হিসেবে থাকবেন না, সেটি নিশ্চিত করা; ভবিষ্যতে যাতে বিভাগের কোনো ব্যাচ বা শিক্ষার্থী যেন এ ধরনের ঘটনাগুলোর সম্মুখীন না হন, সে জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা; তাঁদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে যেন পরীক্ষার ফলাফলে কোনো প্রভাব না পড়ে, তা নিশ্চিত করা; উল্লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে অধ্যাপক আমির হোসেন ভূঁইয়াকে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি–পূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইন ও শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪৭তম ব্যাচের এক ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রথম বর্ষে থাকতে একটা ট্যুরে গিয়েছিলাম। সেই ট্যুর নিয়ে স্যার (আমির হোসেন) আমাদের জড়িয়ে বিভিন্ন ব্যাচের সঙ্গে মানহানিকর কথাবার্তা বলেছেন। এ ঘটনার জের ধরেই আমাদের রেজাল্ট খারাপ হওয়া শুরু করে, এমনকি স্যার আমাদের অভিভাবকদের ফোন দিয়েও বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন। তিনি এর পাশাপাশি একজন যৌন নিপীড়ক। প্রতিবছর নতুন ব্যাচ আসার পরে নির্দিষ্ট কিছু নারী শিক্ষার্থীকে তিনি টার্গেট করেন। এরপর চার থেকে পাঁচ বছর তিনি ওই টার্গেট করা মেয়েদের বিভিন্নভাবে জ্বালান।’

পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার কাছে বিভাগের শিক্ষার্থীরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, আমার সহকর্মীও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। একটি অভিযোগ আসছে, সেটার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ বিচার হওয়া উচিত। সেই স্বার্থে প্রশাসনকে অবগত করেছি নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে বিভাগের কোনো শিক্ষককে যাতে সত্যাসত্য তদন্ত কমিটিতে না রাখা হয়। অতি দ্রুত একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করলে সত্যটা বের হয়ে আসবে এবং অতি দ্রুত এটার সমাধান করে বিভাগে একাডেমিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।’

তদন্ত কমিটি গঠন

পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বিভাগের অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক আমির হোসেন ভূঁইয়ার অভিযোগ তদন্তে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) অতিরিক্ত পরিচালক অধ্যাপক আইরীন আক্তারকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি করা হয়। কমিটিকে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

আজ রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এ বি এম আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।

কমিটির সদস্যরা হলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বুলবুল আহমেদ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বদরুন্নাহার, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. কাশেদুল ওহাব তুহিন এবং প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসলিমা নাহার।

তবে অভিযোগের বিষয়ে আমির হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসার চার দিন পর নিজেরাই ১৮ থেকে ২০ জন ট্যুরে যান। তখন আমি বিভাগের সভাপতি ছিলাম। তাঁরা ট্যুরে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে বিভাগের সভাপতি হিসেবে আমার ওপর দায় আসত। তাঁদের বুঝিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনি। পরে বিভাগ থেকে কাপ্তাইয়ে একটা ট্যুরে গিয়ে তাঁরা রাতে মদ পান করে বমিটমি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলেন। মদ খাওয়ার কারণে কোনো দুর্ঘটনা হলে তখনো দায়টা আমার ওপর আসত। তাই পরের ব্যাচের একটা ট্যুরের সময় যাতে এমন কিছু তাঁরা না করেন, সে জন্য ওই কাহিনি রেফারেন্স হিসেবে শিক্ষার্থীদের বলেছিলাম। আর পরীক্ষায় নম্বরের ক্ষেত্রে বৈষম্যের সুযোগ নেই। কারণ, একজন শিক্ষার্থীর খাতা একাধিক শিক্ষক দেখেন।’

আমির হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের ইন্ধনে তাঁরা এমন মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগ দিয়েছেন। আমি ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেমন শিক্ষক হওয়া উচিত সেসব নিয়ে লেখালেখি করেছি। পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের কেউ হয়তো উপাচার্য হতে চেয়েছিলেন। সেটা তাঁর জন্য বাধা হয়েছিল, তাই আমার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উসকে দিচ্ছেন। আমার পাঁচ হাজারের বেশি সাইটেশন রয়েছে। আমার মতো একজন গবেষককে থামানোর জন্য কতিপয় শিক্ষক এমন অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।’