মেয়েদের ফুটবল 

অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সাফল্য 

পটুয়াখালীর বাউফলের মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মেয়েদের টুর্নামেন্টে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। 

খুদে ফুটবলাররা প্রশিক্ষণে ব্যস্ত সময় পার করছে। গত রোববার বাউফলের মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

অনুশীলন করার মতো নেই মাঠ, নেই কোনো প্রশিক্ষক। চোট পেলে উন্নত চিকিৎসার সামর্থ্য নেই, পায় না পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরাও ফুটবল খেলায় তেমন আগ্রহী নন। 

এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট বরিশাল বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পটুয়াখালীর বাউফলের মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের অদম্য মেয়েরা এখন জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। 

বাউফল উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে আদাবাড়ীয়া ইউনিয়নে মাধবপুর গ্রাম। খুদে ফুটবলাররা গ্রামের বিদ্যালয়টির পরিচিতি এনে দিয়েছে। গত রোববার বিকেলে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েরা ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করছে। স্থানীয় লোকজন এই ছোট ছোট মেয়েদের খেলা দেখছেন। কমল সজ্জাল নামে স্থানীয় এক ফুটবলার মেয়েদের নিয়ে মাঠে খেলাধুলার কলাকৌশল বোঝাচ্ছেন। 

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী তাপরিয়া আক্তার ফুটবল নিয়ে দৌড় যেতে গিয়ে মাঠে পড়ে যায়। তাপরিয়া বলে, তাদের স্কুলের সামনে এই একটি মাঠ, তাও আবার উঁচু-নিচু, কোথাও গর্ত, দৌড়াতে গেলে হোঁচট খেতে হয়। এই মাঠে খুব কষ্টকর। 

তৃতীয় শ্রেণির কমলিকা বিদ্যালয়ের ফুটবল দলের অধিনায়ক। জেলা পর্যায়ে কমলিকা সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিল। চটপটে কমলিকা হাসিমুখে বলে, ‘ফুটবল খেলতে খুব ভালো লাগে। উপজেলা, জেলা ও বরিশাল বিভাগে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। সামনে ঢাকায় খেলতে যাব। কিন্তু ভালো করে প্রস্তুতি নিতে পারছি না। প্রশিক্ষণ দেওয়ার কেউ নেই।’ 

এই গ্রামে অনেকটা নীরবে নিভৃতেই ফুটবলার গড়ার কাজটি করে যাচ্ছেন স্থানীয় ফুটবলার কমল সজ্জাল। তিনি পটুয়াখালী শহরে ফুটবল খেলেন। তাঁর বাড়ি মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কমল সজ্জালকে মেয়েদের ফুটবলের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেন। এক বছর ধরে তিনি বিদ্যালয়ের ১৮টি মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

কমল সজ্জাল বলেন, বিদ্যালয়ের মাঠ খুবই খারাপ। এখানে ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় না। এই মেয়েদের ফুটবল খেলায় ঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে কেউ কেউ একদিন জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারবে। 

এদিকে মেয়েরা যখন মাঠে ফুটবল প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত, তখন মাঠের এক পাশে বিদ্যালয়ের বারান্দায় পায়ে প্লাস্টার নিয়ে বসে খেলা দেখছিল পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী লিমা আক্তার। লিমা এই দলের মধ্য মাঠের খেলোয়াড়। সে বিভাগীয় টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছে। কয়েক দিন আগে মাঠে অনুশীলনের সময় গর্তে পড়ে তার ডান পায়ের গোড়ালি মচকে গেছে এবং হাড়ে ফাটল ধরেছে।

লিমার মা রুমা বেগম বলেন, তাঁদের তিন মেয়েই ফুটবল খেলতে পছন্দ করে। বড় মেয়ে খাদিজা জেলায় অনূর্ধ্ব ১৪ দলে জায়গা পেয়েছে। ছোট মেয়ে সুমাইয়াও (৫) ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করেছে। 

আক্ষেপ করে রুমা বেগম বলেন, সবাই ঢাকা খেলতে যাবে। কিন্তু লিমা পা মচকে এখন মাঠের বাইরে। সে সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকে। মেয়েদের ভালো খাবারই দিতে পারেন না। উন্নত চিকিৎসা হবে কীভাবে? 

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামাল হোসেন বলেন, এখানে যে মেয়েরা ফুটবল খেলে, তাদের অধিকাংশের পরিবারই দরিদ্র। অনুশীলনে খেলোয়াড়দের যে রকম পরিশ্রম করতে হয়, সেভাবে খেতে দিতে পারে না তারা। অভিভাবকেরাও ফুটবল খেলায় তেমন আগ্রহ দেখান না। সরকারিভাবে ও বিত্তবানদের সহায়তা পেলে বিদ্যালয়ের মেয়েদের জাতীয় পর্যায়েও ভালো করতে পারবে।

অদম্য এই মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেখতে গিয়েছিলেন ফুটবল প্রশিক্ষক বাদল হালদার। জেলা ক্রীড়া সংস্থার এই সদস্য বলেন, এই মেয়েরা জেলার সুনাম এনে দিয়েছে। অনেক সংকটের ভেতরও জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখছে। এদের জেলা শহরে নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে আরও ভালো করবে। 

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুকুল রানী পাল বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিভাগীয় পর্যায়ে মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কিছু আর্থিক সহায়তা পাওয়া গেছে। তাই দিয়ে কোনোরকমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।