গত ১৬ জুলাই বেলা তিনটা। চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা। মুহূর্তেই শুরু হয় ছাত্রদের ওপর হামলা-গুলি। জবাবে ছাত্ররাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেদিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে অস্ত্রধারীর ছোড়া একটি গুলি লাগে মো. শুভ হোসেনের ডান চোখে। চোখের তিনটি স্তর ভেদ করা সেই ছররা গুলি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
মো. শুভ হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর চট্টগ্রামসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। গত শুক্রবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় শুভর। তিনি বলেন, দুবার অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে তাঁকে। তবু চোখের ভেতর থেকে গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত তাঁর প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রবাসী বাবা ধার করে টাকার জোগান দিচ্ছেন। বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে টাকা না লাগলেও যাতায়াত, থাকা ও খাওয়া বাবদ টাকা ব্যয় হচ্ছে।
গত ১৭ জুলাই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে প্রথম অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। পরে ৮ অক্টোবর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়েছে। বর্তমানে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল বিল্লাল হোসেনের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। আগামী মাসে তাঁর চোখে তৃতীয়বারের মতো অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি ডান চোখে দেখতে পাবেন কি না, ওই অস্ত্রোপচারের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।
শুভর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নে। বাবা মো. আকবর হোসেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী। তিন ভাইয়ের মধ্যে শুভ সবার ছোট। তিনি জানান, ডান চোখে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তাঁর। এরপরও শেষ চেষ্টায় রয়েছেন। আগামী মাসে তৃতীয় অস্ত্রোপচারের পর যদি চোখের উন্নতি না হয়, তবে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেবেন তিনি। তাঁর আক্ষেপ, তাঁকে সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কেউ কোনো অর্থসহায়তা দেননি। এমনকি তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি।
শুভর চিকিৎসার খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অভি দাশ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন। লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার বলেন, তিনি সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছেন। আলাদাভাবে শুভর বিষয়ে তিনি কিছু শোনেননি। শুভর পরিবার থেকেও কেউ আসেননি। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের তালিকা চূড়ান্তের কাজ প্রায় শেষের দিকে। তালিকা চূড়ান্ত হলে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। এরপরও আলাদাভাবে কেউ যদি তাঁদের কাছে আসেন, কোনো সহায়তার প্রয়োজন হয়, সেটি দেওয়া হবে।
শুভ যখন গুলিবিদ্ধ হন, তখন বিকেল আনুমানিক সাড়ে চারটা। মুরাদপুর পদচারী–সেতুর নিচে আসার পর তিনি গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে ছররা গুলি লাগে তাঁর চোখে। নিচে পড়ে গিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য আশপাশের লোকদের ডাকতে থাকেন। তবে সাড়া পাননি। পরে প্রায় এক ঘণ্টা পর নানা প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান।
শুভ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলি লাগার পর রক্তে তাঁর পুরো শরীর ভিজে যায়। হাসপাতালে যাওয়ার প্রায় ৪০ মিনিট পর চিকিৎসক চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। পরে ওই দিনই ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। ভোরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পৌঁছান। তবে সেখানে সারা দিন কোনো চিকিৎসকের দেখা তিনি পাননি। ওই দিন সন্ধ্যা থেকে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। চোখের প্রথম অস্ত্রোপচার হয় ওই দিন।
নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে শুভ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বপ্ন ছিল পুলিশ ক্যাডার হওয়া। তিন বছর ধরে বিভিন্ন কসরত করে শরীরের ফিটনেস ঠিক রাখছিলেন। চোখে গুলি লাগার পরেই তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর এই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। তবে তিনি জীবনের হাল ছাড়ছেন না। নিজের এক চোখের আলো হারালেও দেশে আলো আসুক এটিই তাঁর চাওয়া।
গত ৩০ অক্টোবর থেকে বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। শুভর সহপাঠীরা পরীক্ষা দিতে পারলেও তিনি রয়েছেন অনিশ্চয়তায়। শুভ বলেন, চোখের সমস্যার কারণে তিনি পড়তে পারছেন না। এখনো চোখে গুলি থাকায় মাঝেমধ্যে ব্যথা দেখা দেয়। মৃত্যু পর্যন্ত চোখে এই গুলি নিয়ে তাঁকে থাকতে হতে পারে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসক। পরীক্ষা শুরুর কথা শুনে তাঁর মন খারাপ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তিনি নিজে গিয়ে সহ-উপাচার্যের (প্রশাসনের) সঙ্গে ২৫ অক্টোবর যোগাযোগ করেছেন। পরে সমস্যার কথা জানালে তাঁকে লিখিত আবেদনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান চান মো. শুভ হোসেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রকে আলোকিত করতে নিজে এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। কিন্তু একটিবার রাষ্ট্রের কেউ যোগাযোগ করেননি—এটিই আক্ষেপ তাঁর। তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজের সমস্যার কথা জানাতে চান। তিনি চান তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁর কর্মসংস্থান যেন সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়।