‘দেশের অবস্থা ভালো না, ছোট ভাইকে বাড়িতে নিয়ে আসি’—শয্যাশায়ী মা ঝরনা বেগমকে এ কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন চিকিৎসক সজীব সরকার (৩০)। রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায় পৌঁছার পর অন্য যাত্রীর সঙ্গে তাঁকেও বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। অদূরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পুলিশ মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। সেখান থেকে তাঁর ছোট ভাই আবদুল্লাহ সরকারের মাদ্রাসার দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। হেঁটে হেঁটে মাদ্রাসাটির উদ্দেশে রওনা হলে গুলি লেগে ঘটনাস্থলে নিহত হন সজীব।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ছেলের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনায় গতকাল বুধবার এসব বলেন সজীবের বাবা হালিম সরকার। সজীবের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামে। তবে মা-বাবাকে নিয়ে নরসিংদী শহরের জেলখানার মোড় এলাকার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকতেন। সেই সঙ্গে বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর এলাকার কেয়ার হাসপাতালে রোগী দেখতেন।
গত ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিকেল ৫টার কাছাকাছি সময়ে রাজধানীর উত্তরায় সজীবকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে বলে দাবি করেন হালিম সরকার। তিনি বলেন, ‘সজীব কোনো দল করত না, কোটা আন্দোলনেও যায়নি, তাঁকে এভাবে কেন হত্যা করা হলো?’
ওই দিন (১৮ জুলাই) মুঠোফোনে সজীবের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। খবরটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, ঢাকায় ছুটে যান তাঁর ছোট বোন সুমাইয়া সরকার। তিনি বলেন, ‘ওই রাতে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কল করে একজন বলেন, সজীব সরকার আপনার ভাই? তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাসপাতালে গিয়ে ভাইয়াকে আর খুঁজে পাই না। দীর্ঘ সময় পর সেখানকার লোকজন দুটি লাশ দেখিয়ে বলেন, এখানে আছে কি না দেখেন তো? দেখি ভাইয়ার গুলিবিদ্ধ লাশ। পরে রাতেই তাঁর লাশ নিয়ে ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে নিয়ে বাড়ি ফিরি।’
উত্তরার একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত আবদুল্লাহ সরকার। আন্দোলনকে ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে তাকে সেখান থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে যান সজিব। তবে আবদুল্লাহ বাড়ি ফিরলেও সজিব আর ফিরতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে আফসোস করছিল আবদুল্লাহ। সে জানায়, ‘আমাকে আনতে গিয়েই ভাইয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। অথচ সেই আমিই বোনের সঙ্গে রাতে ভাইয়ার লাশ বাড়ি নিয়ে এসেছি, তাঁর জানাজা আমি পড়িয়েছি।’
ছেলেকে হারিয়ে মা ঝরনা বেগমের অবস্থা পাগলপ্রায়। অসুস্থতা, আহাজারি আর শোক-বিলাপে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘ছোট ভাইকে বাড়িতে নিয়ে আসি—বলে সেদিন ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিল। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকেও তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। এরপর তাঁকে আর ফোনে পাইনি। রাত ১টা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলাম। পরে শুনি, গুলিতে ছেলে মারা গেছে। আমার ডাক্তার ছেলেকে তারা গুলি করে মারবে কেন?’