‘আমার কলিজার টুকরা ছেলেডা ছোট্ট থাইক্কাই মাইনষের দুঃখ-কষ্ট দেখলে ঠিক থাকতে পারত না। কারও কোনো অসুবিধার খবর শুনলে সে সবার আগে হাজির হইয়া সমাধানের চেষ্টা করত। কারও রক্তের প্রয়োজন হইলে সে রক্ত দিয়া সাহায্য করত। তার বুকে এমন কইরা গুলি চালাইয়া মারতে হইল! যে ছেলে মানুষরে রক্ত দিছে, তার রক্তেই রাজপথ ভাসছে।’ কথাগুলো বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী ওমর ফারুকের বাবা আবদুল খালেক।
গত ১৯ জুলাই দুপুরে আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন ওমর ফারুক। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২১ জুলাই গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
ওমর ফারুক নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের সিংহা গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে। আবদুল খালেক সংযুক্ত আরব আমিরাতপ্রবাসী। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে পরদিনই দেশে চলে আসেন। নিহত ওমর ফারুক ঢাকায় কবি নজরুল সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি ‘দুর্গাপুর ব্লাড ডোনার সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
মানুষকে রক্তদানে সহায়তার উদ্দেশ্যে সংগঠনটি তৈরি করেছিলেন তিনি।
গত মঙ্গলবার বিকেলে ওমর ফারুকের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর ছোট ভাই বাকলজোড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ অনিক (২১)। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা দুই ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা কোনো দিন মানুষের ক্ষতি করিনি। আমার ভাই মানুষের বিপদে–আপদে এগিয়ে যেতেন। কারও রক্তের প্রয়োজন হলে ভাইয়া ব্যবস্থা করে দিতেন। গুলিতে ভাইয়ের মৃত্যুতে আমার অর্ধেক শরীর অবশ হয়ে গেছে। এসব ঘটনার বিচার তো আর পাব না।’
আবদুল্লাহ অনিক বলেন, ‘ভাইয়া শুক্রবার (২১ জুলাই) বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছেন। পরে বন্ধুদের সঙ্গে কোটা সংশোধন আন্দোলনে যান। লক্ষ্মীবাজার এলাকায় তাঁদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে ভাইয়ার বুকে তিনটি গুলি লাগে। বন্ধুরা তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।’
ওমর ফারুকের চাচা মো. আবদুল কাদির বলেন, ‘গুলি দিয়া আমার ভাতিজার বুকটা ঝাঁঝরা কইরা দিছে। একটা তরতাজা জীবন এইভাবে ঝইরা গেল। এমন মৃত্যু কখনো মাইন্না নেওন যায় না।’
ভাতিজার লাশ পাওয়া নিয়ে ভোগান্তি সম্পর্কে আবদুল কাদির বলেন, ২১ জুলাই দুপুরে ওমর ফারুকের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তাঁরা ঢাকায় রওনা হন। রাত ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে জানতে পারেন, ভাতিজা মারা গেছেন। পরে লাশ খুঁজতে চাইলে কর্তৃপক্ষ ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। হাসপাতালের লোকজন বলেন, থানা-পুলিশের অনুমতি লাগবে। পরে শাহবাগ থানায় গেলে পুলিশ বলে, ওমর ফারুক নামের কারও লাশ সেখানে নেই, তারা অনুমতি দেয়নি। সারা রাত হাসপাতাল আর থানায় দৌড়াদৌড়ি করেছেন তাঁরা। পরদিন তাঁরা স্থানীয় সংসদ সদস্যকে বিষয়টি জানান। পরে পুলিশ লাশ খোঁজার অনুমতি দেয়। বিকেলে একটা রুমে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখেন, সেখানেই ভাতিজার লাশটা পান।
ওমর ফারুকের বাবা আবদুল খালেক বলেন, ‘আমার ছেলে এখন দুনিয়াত নাই। আমি সবার কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই। বিচার চাইয়া আর কী হইব? জীবন তো আর ফিইরা আইব না।’
প্রতিবেশী হফিজ উদ্দিন বলেন, ওমর ফারুক খুবই নম্রভদ্র ছেলে ছিল। কোনো রোগীর রক্ত প্রয়োজন হলে সে জানতে পারলে তা ব্যবস্থা করে দিত।