ছোট্ট একটি ঘরে কাটছিল রাসেল-টুম্পার জীবন। এখন তাদের জীবন সংকটাপন্ন। চিকিৎসকেরা নানাভাবে চেষ্টা করছেন তাদের বাঁচিয়ে রাখার। কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ করে তারা ঘরের ভেতরেই পড়ে আছে। কক্সবাজার শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে থাকা রাসেল ও টুম্পা নামের দুটি সিংহ খুবই অসুস্থ।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে রাসেল নামের সিংহটির খাবার খাওয়ায় অনীহা দেখা দেয়। সিংহটি শারীরিকভাবে অসুস্থতায় ভুগছে। তার পায়ে ব্যথা। বাত রোগের কারণে ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে পারছে না। টুম্পা নামের সিংহীর অবস্থাও তাই। টুম্পা ৪ জানুয়ারি থেকে অসুস্থ। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার পর ভালো হয়ে নিয়মিত খাবার খায়। কিন্তু ৫ জানুয়ারি থেকে আবার সে খাচ্ছে না। চলাফেরাও অনেকটা অস্বাভাবিক। দিন দিন শরীরের ওজন কমে যাচ্ছে।
সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, রাসেল ও টুম্পার অসুস্থতার খবর পেয়ে ৪ জানুয়ারি পার্ক পরিদর্শনে আসেন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) রফিকুল ইসলাম চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর সিংহ দুটির চিকিৎসার জন্য পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বিবেক চন্দ্র সূত্রধরকে প্রধান করে গঠিত বোর্ডে ছিলেন সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন হাতেম সাজ্জাদ মো. জুলকার নাইন ও চকরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোস্তাকিম বিল্লাহ।
বর্তমানে টুম্পার বয়স ১৫ ও রাসেলের বয়স ১৬ বছর। প্রকৃতিতে পুরুষ সিংহের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ৮ থেকে ১০ বছর এবং আবদ্ধ অবস্থায় স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ১৬ থেকে ২০ বছর। সে ক্ষেত্রে সিংহ দুটির আয়ুষ্কাল শেষ পর্যায়ে।জুলকার নাইন, ভেটেরিনারি সার্জন, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন জুলকার নাইন বলেন, সিংহ দুটিকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রেখে মেডিকেল বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বার্ধক্যের কারণে সিংহ দুটির এমন অবস্থা হয়েছে। বর্তমানে টুম্পার বয়স ১৫ ও রাসেলের বয়স ১৬ বছর। প্রকৃতিতে পুরুষ সিংহের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ৮ থেকে ১০ বছর এবং আবদ্ধ অবস্থায় স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ১৬ থেকে ২০ বছর। সে ক্ষেত্রে সিংহ দুটির আয়ুষ্কাল শেষ পর্যায়ে।
চকরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোস্তাকিম বিল্লাহ বলেন, সিংহ দুটির বাত, ব্যথা ও অবশ হওয়া, শরীরের চামড়া ভাঁজ হওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, খাবার খাওয়ায় অনিয়ম দেখা দিয়েছে। চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। সিংহের শরীরে আঘাত কিংবা জখমের চিহ্ন নেই।
রাসেল ও টুম্পাকে বেষ্টনীতে রেখে চিকিৎসা চলছে। দর্শনার্থীদের সেদিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।মো. মাজহারুল ইসলাম, সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক
সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার বছর বয়সে ২০০৪ সালে সোহেল নামের একটি সিংহ সাফারি পার্কে আনা হয়েছিল। এরপর সোহেলের সঙ্গী হিসেবে আনা হয় হীরা নামের একটি সিংহীকে। তাদের সংসারে আসে রাসেল (১৬) নামের এক সিংহ। রাসেলকে রেখে বেষ্টনীতেই মারা যায় হীরা। এরপর সোহেলের সঙ্গী হয় নদী (১৫)। সোহেল-নদীর সংসারে আসে টুম্পা ও সম্রাট নামের দুই সন্তান। টুম্পার বয়স এখন ১৫ আর সম্রাটের ৯। সোহেলের বয়স হয়েছিল ২২ বছর। বার্ধক্যের কারণে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যায় সোহেল। আর টানা দুই মাস চিকিৎসার পর গত বছরের ২২ এপ্রিল মারা যায় নদী। ২৮ ফেব্রুয়ারি নদীর গলা ও পেটে কামড় বসিয়ে দিয়েছিল নিজের পেটে ধারণ করা সিংহ সম্রাট।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, রাসেল ও টুম্পাকে বেষ্টনীতে রেখে চিকিৎসা চলছে। দর্শনার্থীদের সেদিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম এই সাফারি পার্ক। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। বর্তমানে পার্কের বিভিন্ন বেষ্টনীতে আছে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, ভালুক, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজ ধনেশ, কাক ধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙ্গিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বন গরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১টি প্রাণী। আর উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫টি প্রাণী। এর মধ্যে গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খ্যাঁকশিয়াল, বনরুই উল্লেখযোগ্য।