নওগাঁর সাপাহার বাজারে ঢলন প্রথায় ঠকছেন কৃষক

সাধারণত বাজারে যেকোনো পণ্য ৪০ কেজিতে এক মণ হয়। কিন্তু এই বাজারে আম বিক্রি করতে গেলে ৫২ কেজিতে মণ ধরেন ব্যবসায়ীরা।

● নষ্ট ও পাকলে ওজন কমে যাওয়ার অজুহাতে বেশি নেওয়া হয়।

● বেশি নেওয়ার পাশাপাশি প্রতি মণে কমিশন ৭০ টাকা।

● কৃষকেরা ঢলন প্রথা বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন।

দেশের অন্যতম আম উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁর সবচেয়ে বড় আমের হাট সাপাহার বাজার। যেখানে ঢলন প্রথার নামে ৫১ থেকে ৫২ কেজিতে মণ হিসেবে আমচাষিদের আম কিনছেন আড়তদারেরা। ফলে তাঁদের আমের পাঁচ ভাগের এক ভাগই চলে যাচ্ছে ঢলনে। ওজনে কারসাজির পাশাপাশি প্রতি মণ আমের জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে ৭০ টাকা করে কমিশন আদায় করছে আড়তদারেরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরে দেশে আমের জন্য সুখ্যাতি পেয়েছে ধানের দেশ নওগাঁ। এবার জেলায় আমের ফলন বেশি হয়েছে। কৃষি বিভাগ জেলার ৩০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ জেলায় চাষ হওয়া বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে এবার ৬০ শতাংশের বেশি আম্রপালি আমের চাষ হয়ে। আম্রপালি আম বাজারে ওঠায় জমে উঠেছে এখানকার আমের বাজার।

আমচাষিরা বলছেন, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার আমের ফলন হয়েছে ভালো। তবে ঢলন ও কমিশনের কারণে তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সাধারণত ৪০ কেজিতে এক মণ বোঝায়, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এখানে ঢলন প্রথার নামে ৪৫-৪৬ কেজিতে এক মণ ধরে আম বেচাকেনা হয়ে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটি বেড়ে হয়ে গেছে ৫১ থেকে ৫২ কেজিতে।

মণপ্রতি কৃষকের ১১ থেকে ১২ কেজি আম বেশি নেওয়ার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই আড়তদারদের কাছে। তবে তাঁরা বলছেন, কাঁচামাল পাকলে কমে যায়, নষ্ট হয়, ফলে ঢলন ছাড়া তাঁরা আম কিনতে পারেন না। তাঁরা চাষিদের কাছে থেকে যেভাবে ওজনে বেশি নিচ্ছেন, একইভাবে ব্যাপারীদের কাছে তাঁরা আম বিক্রি করে থাকেন।

সাপাহার উপজেলা সদরের জিরোপয়েন্ট থেকে সাপাহার-নজিপুর সড়কের দুই পাশে দিবর দিঘির মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার অংশজুড়ে সাপাহার বাজার। প্রতিদিন অন্তত দেড় কোটি টাকার আম বিকিকিনি হচ্ছে। বর্তমানে চলছে আম্রপালি আমের ভরা মৌসুম। এ ছাড়া ফজলি, ল্যাংড়া ও ব্যানানা আমও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মণ আম্রপালি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। ফজলি আমের দাম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

গত বুধবার দুপুরে সাপাহার বাজারে উপজেলার গোয়ালি এলাকা থেকে আমাচাষি সাহাবুল হক দুটি ভ্যানে ১০ মণ আম্রপালি বিক্রি করতে আসেন। তিনি বলেন, ১০ মণ আম আড়তে বিক্রি করার সময় ঢলন দিতে গিয়ে হয়ে গেল আট মণ। বাগান থেকে আম নিয়ে আড়ত পর্যন্ত দুই মণ আম নাই হয়ে গেল। ৫২ কেজিতে মণ ধরল। ঢলন প্রথা আমাদের জন্য অভিশাপ। চার-পাঁচ বছর আগে কাঁটার পাল্লায় যেটি ৪৫ কেজিতে মণ হতো, সেখানে এখন ডিজিটাল ওজন মেশিনে ৫১-৫২ কেজিতে মণ নিচ্ছে। আবার প্রতি মণ আমের জন্য ৭০ টাকা করে কমিশন নেওয়া হচ্ছে। আড়তদারদের কাছে চাষিরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

সাপাহার পাইকারি আমবাজারে এখন সবচেয়ে ভালো আম্রপালি আমের কেজি অন্তত ৭০ টাকা। যেখানে মণপ্রতি ঢলনের নামে ১২ কেজি বেশি আম দিতে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে ৮৪০ টাকা। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় আমচাষিরা চাইছেন উচ্চমূল্যের এ বাজারে এ ঢলন প্রথার সমাপ্তি হোক।

গত বুধবার সাপাহার বাজারের সাহা ফল ভান্ডার, মেসার্স জাহাঙ্গীর ট্রেডার্স ও সাপাহার আম হাট নামের তিনটি আমের আড়তে চাষিদের আনা আম দুটি করে ক্যারেট ডিজিটাল স্কেলে তুলে ওজন করতে দেখা যায়। ক্যারেটসহ ওজন এল ৫২ কেজি, কোনোটিতে ৫৩ কেজি। দুটি ক্যারেট মিলিয়ে ৫২ কেজি বা এর বেশি না হলে এক মণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। আড়ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে নিলেন।

মেসার্স জাহাঙ্গীর ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আম কৃষকের কাছ থেকে কেনার সময় যখন ওজন করা হয়, তখন দুটি প্লাস্টিকের ক্যারেটের ওজন দুই কেজি ধরা হয়। এ হিসাবে আমরা প্রকৃতপক্ষে ঢলন নিচ্ছি ১০ থেকে ১১ কেজি। ঢলন প্রথা অনেক আগে থেকে চলে আসছে। দেশের আমের বড় বড় বাজার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট ও রাজশাহীর বাণেশ্বরেও ঢলন নেওয়া হয়। ঢলন নিতে হয় বিভিন্ন কারণে। চাষির কাছ থেকে আম কেনার পর বাছাই করতে হয়। এ সময় অনেক আম নষ্ট বের হয়, সেগুলো বাদ পড়ে।’

এ বিষয়ে সাপাহার আম আড়তদার সমিতির সভাপতি কার্তিক সাহা বলেন, ‘মূলত আগে থেকে এক মণে নেওয়া হতো ৪৮ কেজি। কিন্তু কিছুদিন ধরে ঘন ঘন বৃষ্টির কারণে কৃষকেরা ভেজা আম আড়তে নিয়ে আসছেন। ভেজা আম আড়তে রাখার পর নষ্ট হচ্ছে বেশি। এ কারণে এখন নেওয়া হচ্ছে ৫১-৫২ কেজি। তা–ও ক্যারেটে ওজন করার জন্য।’

এ বিষয়ে সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্যাহ আল মামুন বলেন, ‘এবার প্রশাসনের মধ্যস্থতায় স্থানীয় আড়তদার ও আমচাষি সমিতি ৪০ কেজি আমের জায়গার ৫ কেজি বেশি এবং ক্যারেটসহ ওজনের কারণে আরও ৩ কেজি বাড়তি ধরে ৪৮ কেজিতে মণ ধরে আম বিক্রির সমঝোতা করা হয়। কিন্তু ৪৮ কেজির জায়গায় ৫০ কিংবা ৫২ কেজি নেওয়ার সুযোগ নেই। ভুক্তভোগী কোনো বিক্রেতা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’