বিইআরসি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৮৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু দোকানে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
‘সরকার এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম কমালেও ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে না। আবার মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিলে মুহূর্তে তা বেড়ে যায়। বাজারে সব জিনিসপত্রের দামই তো নিয়ন্ত্রণহীন। কী আর বলব, আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের তো বলার কিছু নেই।’
এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০০ থেকে ২২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব কথা বলেন বরিশাল নগরের ফকিরবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মাসুদ পারভেজ। এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে বিনা নোটিশে সব পণ্যের দাম বাড়ে, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সেই দামেও গ্যাস পাওয়া যায় না, অথচ আমাদের আয় বাড়ে না। আমরা যে কীভাবে বাঁচব, ভেবে কূল পাচ্ছি না।’
৩ সেপ্টেম্বরে প্রতি ১২ কেজির তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৮৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সে হিসাবে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে দাম ১২ কেজিতে এবার ১৪৪ টাকা বেড়েছে। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকেই সমন্বিত এই দাম কার্যকর হয়। এর আগের মাসে ১২ কেজি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ১৪০ টাকা। তবে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও সরকার নির্ধারিত দামে বরিশালের বাজারে গ্যাস মিলছে না।
ভোক্তাদের অভিযোগ, বরিশালে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকার নিচে গ্যাস তাঁরা কিনতে পারছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী গতকাল বলেন, ‘মাসে যে কয় টাকা বেতন পাই, তার বড় অংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। এরপর বাচ্চাদের পড়াশোনা, সংসার খরচ এখন আর চলে না। তাই পরিবারে মাছ, মাংস কেনা কমিয়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু কাটছাঁট করেও এখন আর চলছে না। রাত পোহালেই বেড়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্যর দাম। এখন আবার গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যে এর প্রভাব পড়বে আরেক দফা।’
গ্যাসের দাম নতুন নির্ধারণ করে দেওয়ায় ১৪৪ টাকা বাড়লেও ভোক্তা পর্যায়ে তা কিনতে হচ্ছে আরও অন্তত ১৭০ টাকা বেশি দিয়ে। ফলে আগের মাসের চেয়ে শুধু রান্নার গ্যাসে ভোক্তাদের ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা ব্যয় বেড়েছে।
নগরের রূপাতলী এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, ‘শুনেছি, সরকার সপ্তাহখানেক আগে গ্যাসের দাম ১৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ২৮৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু গতকাল রূপাতলী বাজারে খুচরা দোকান থেকে ১২ কেজির এলপিজি ১ হাজার ৪২০ টাকা দিয়ে কিনেছি।’
মেহেদী হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা কি দেখার কেউ নেই। সরকারের আদেশ এভাবে লঙ্ঘন করা হয় কীভাবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
সরেজমিনে নগরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা যায়, পেট্রোম্যাক্স, ফাইবার, টোটাল, লাফস, যমুনা, দুবাই বাংলা, ফ্রেশ, জেএমআই, বেক্সিমকো, সেনাসহ বিভিন্ন কোম্পানির ১২ কেজি গ্যাস সিলিন্ডার খুচরা পর্যায়ে ১ হাজার ৪২০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘আমরা নিরুপায়। ডিলারদের কাছ থেকে যে দামে আমরা গ্যাস পাই, তার চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা লাভে বিক্রি করি। তারপরও চাহিদামতো ডিলাররা গ্যাস দেন না। বর্ধিত দামে গ্যাস কিনলেও ডিলাররা এর বিপরীতে কোনো ক্রয় রসিদ দেন না।’
বটতলা বাজারের ব্যবসায়ী মাহতাব হোসেন আকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোম্পানিভেদে ডিলারদের কাছ থেকে ১ হাজার ৩৪০ থেকে ১ হাজার ৩৮০ টাকায় গ্যাস কিনি। বিক্রি করি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়। এখন ডিলাররা দাম না কমালে আমাদের কী করার আছে।’
সেনা এলপি গ্যাসের ডিলার সাইফুল আহসান বলেন, ‘দোকান, গুদামভাড়া, কর্মচারীর বেতনসহ সিলিন্ডারপ্রতি ৩০ টাকা বাড়তি খরচ হয়। তবে চাহিদা তুলনায় কম বিক্রি হলে এ খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ কারণে কিছুটা বাড়তি দামে গ্যাস বিক্রি করতে হয়। কোম্পানিরে মূল্য সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ায় আমরা কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হই।’
লাফস এলপি গ্যাসের ডিলার মো. রবিউল ইসলাম খান মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই দাম মানেনি বেসরকারি কোম্পানিগুলো। কারণ, ডলার-সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। আবার সরকার ডলারের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, বাস্তবে বাজারে তার দাম বেশি। ফলে কোম্পানিগুলো এখন গ্যাস আমদানি করতে পারছে না, পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়তি থাকায় দাম বেশি পড়ে যাচ্ছে। ফলে সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম সামঞ্জস্য হচ্ছে না। তাই বাড়তি দামে গ্যাস বিক্রি করতে হচ্ছে।
কিন্তু সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীদের এমন যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না ভোক্তারা। এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা সরকারের আদেশ-নির্দেশ মানবেন না, এটা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অবশ্যই গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের তদারকি ও অভিযান চালানো দরকার। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এসব যুক্তি প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুমি রানী মিত্র মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, ‘এর আগে যখন দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বেশি দামে গ্যাস বিক্রির অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে তাঁদের জরিমানা করেছিলাম। এমনকি বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা কয়েক দফা বিভিন্ন এলপিজি কোম্পানির ডিলারদের নিয়ে সভাও করেছি। এবার নতুন দাম নির্ধারণের পর আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে অভিযান বা তদারকির কোনো নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলেই দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেব।’