ভাটি, পাহাড় আর সমতল—এই তিনের সমন্বয়ে ভৌগোলিকভাবে পরিচিত দেশের ঐতিহ্যবাহী জেলা হবিগঞ্জ। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি গ্রামের বাসিন্দা মান্নি আখতার (২২)। পেশায় গৃহিণী, তবে নিজ বাড়িতে গরু বেচাকেনার ব্যবসা করেন। তাঁর স্বামী মো. ইজ্জত আলী কলার ব্যবসায়ী। একসময় ইন্টারনেটের ব্যবহার তেমন একটা জানতেন না মান্নি। সম্প্রতি এ ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছেন তিনি। তার পর থেকে মান্নির মনে হয়েছে, ব্যবসার ক্ষেত্রে এই জ্ঞান কাজে লাগালে তিনি লাভবান হবেন। গরুকে কখন কোন খাদ্য খাওয়ানো প্রয়োজন বা অসুস্থ গরুকে সুচিকিৎসার জন্য কী করতে হবে, তা ইন্টারনেটে বিভিন্ন ভিডিও দেখে প্রাথমিক তথ্য ও ধারণা পাচ্ছেন তিনি। এর পাশাপাশি গরু কেনাবেচাতেও সহায়ক হবে ইন্টারনেট।
‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় সারা দেশের মতো হবিগঞ্জেও শেষ হয়েছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে গ্রামীণফোনের উদ্যোগটি হবিগঞ্জে শুরু হয়েছিল গত ১৮ নভেম্বর থেকে। এ জেলার ৯টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ৩ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি গ্রামের উঠান বৈঠকে অন্যান্য নারীর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন মান্নি আখতারও।
উঠান বৈঠক থেকে নতুন কী শিখলেন? জানতে চাইলে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মান্নি আখতার বলেন, ‘আমি এখন আমার ব্যবসায়িক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করব। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেব। কোন ধরনের গরু আমার কাছে আছে, সেগুলোর ছবি দেব। আশা করি, এতে গরুর ন্যায্য মূল্য পাব। পাশাপাশি আমার ব্যবসারও প্রসার ঘটবে।’
মান্নি আখতারের মতো বহু নারী উঠান বৈঠক শেষে এমন ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তেমনই একজন রিচি আড়িয়াকোণার শিল্পী সরকার ও একই গ্রামের তানিয়া আক্তার। একই দিনের আয়োজনে অংশ নেন তাঁরা। শিল্পী বলেন, ‘আমি ১০ম শ্রেণিতে পড়ছি। পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ করি। এখন ইন্টারনেটে ডিজাইনের ভিডিও দেখে নতুন নতুন ডিজাইন শিখব।’
তবে তানিয়া আক্তারের ভালো লেগেছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সেশন। তিনি বলেন, ‘উঠান বৈঠকে এসে নতুন অনেক কিছু শিখতে পেরে আমার খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ করে শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন বিষয় শিখিয়েছে। এটা আমিসহ সবার অনেক কাজে দেবে।’
৩ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার শানখলা ইউনিয়নে সম্পন্ন হয় উঠান বৈঠক। সেখানে অংশ নেন ফান্ডাইল গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষার্থী পপি (১৭)। অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পপি বলেন, ‘অনুষ্ঠানে এসে অনেক কিছু শিখতে পারছি। বিশেষ করে নারীর রক্তশূন্যতাজনিত সমস্যা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি, যা আমার আগে জানা ছিল না।’
হবিগঞ্জের উঠান বৈঠকের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন হবিগঞ্জ বন্ধুসভার পাঁচ সদস্যের একটি দল। তাঁরা হলেন জেরিন গাজী, মশিউর রহমান, তানিম আনছার, শরমী দাস ও দলনেতা জয় দাস।
দলনেতা জয় দাস বলেন, ‘আমাদের কাছে এ আয়োজন ছিল নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা। প্রথম দিকে কাজ কীভাবে করব, এ নিয়ে ভাবনা থাকলেও পরে তা গুছিয়ে নিয়েছি সবাই মিলে। পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে কাজ করার সময়টা দারুণভাবে আমরা উপভোগ করি।’
দলের নারী সদস্য জেরিন গাজী অধিকাংশ উঠান বৈঠকে সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘একসঙ্গে এত মানুষের সামনে কথা বলার অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে কয়েকটা দিন মিশে বা কাজ করে বেশ উপভোগ করেছি।’
গ্রামীণ নারীদের জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ কার্যক্রমটি। মানুষের নানাবিধ চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি প্রান্তিক নারীদেরকে সরাসরি শেখাতে এ উদ্যোগ। এরই মধ্যে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নের বেশি স্থানে শেষ হয়েছে উঠান বৈঠক। আয়োজনটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক।