বান্দরবানের লামা সরই ইউনিয়নে ত্রিপুরাপল্লি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার পুলিশ গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে। এ ঘটনায় সামনে এসেছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের নাম। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও এলাকাটির হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) দুর্যোধন ত্রিপুরার বক্তব্যে সাবেক এই আইজিপির নামে আসে।
পুলিশ বলেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় স্টিফেন ত্রিপুরা (৫০), মশৈনিয়া ত্রিপুরা (৪৪), যোয়াকিম ত্রিপুরা (৫২) ও মো. ইব্রাহিমকে (৬৫) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে মো. ইব্রাহিম বেনজীর আহমেদের নামে দখল করা জমির দেখভাল করতেন। তাঁদের সবার বাড়ি সরই ইউনিয়নে। বুধবার রাতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে পূর্ববেতছড়া পাড়ার ১৭টি ঘরবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তখন পাড়ার বাসিন্দারা সবাই গির্জায় বড়দিনের উৎসবে ছিলেন। পাড়ায় কোনো লোকজন ছিলেন না। এ ঘটনার পর বুধবার রাতে মামলা হয়। আজ সকালে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাওছার পূর্ববেতছড়া পাড়া পরিদর্শন করেন। তাঁরা পাড়ার পোড়াভিটা ঘুরে দেখেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন। অবশ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে ১০ কেজি ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৫০ কেজি করে চাল, তিনটি করে কম্বল, ডাল, তেল ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
পূর্ববেতছড়া পাড়ার বাসিন্দা গঙ্গামণি ত্রিপুরা ও চন্দ্রমণি ত্রিপুরা প্রথম আলোকে জানান, পাড়ায় ১৯টি পরিবার থাকত। এর মধ্যে ১৭টি পরিবারের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কেউ কোনো জিনিসপত্র বের করতে পারেননি। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া দুটি ঘরে রাতে কিছু পুরুষ থাকছেন। বাকিরা পাশের আরেকটি পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।
আগুনের ঘটনায় যা জানা গেল
পাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) পাইসাপ্রু ত্রিপুরার অভিযোগ, সাবেক আইজিপির নামে জায়গা দখলদার চক্রই পাড়ায় আগুন লাগিয়েছে। দখলকৃত জমি দেখভালকারী মো. ইব্রাহিম প্রায় ওই পাড়ায় যেতেন। তাঁর সঙ্গে স্থানীয় অনেকেই ঘোরাফেরা করতেন। গত নভেম্বরে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে হুমকি দেওয়া হয়েছে পাড়াবাসীকে।
পাইসাপ্রু ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগে সাবেক আইজিপির নামে পুলিশে কর্মরত চট্টগ্রামের দুজন কর্মকর্তা, লামা ও জেলা সদরের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তংগোঝিরিপাড়া ও সবিচন্দ্র পাড়ার পাড়াবাসীর ১০০ একর জুমের জমি দখল করে নেন। স্থানীয় জুমিয়ারা বাধা দিলে আইজিপি ও এসপির বাগান জানিয়ে জেলের ভাত খাওয়ানোর হুমকিও দেওয়া হয়। দখলদারেরা সেখানে একটি আধা পাকা বাড়ি তৈরি করেন। এটি দেখভাল করতেন মো. ইব্রাহিম। এ ছাড়া বাগানটিতে যাওয়ার জন্য জেলা পরিষদ থেকে ইট বিছানো একটি সড়ক নির্মাণ করা হয়।
ডলুছড়ি মৌজার দায়িত্বপ্রাপ্ত হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) দুর্যোধন ত্রিপুরা জানান, বান্দরবান সদর উপজেলায় সাবেক আইজিপি বেনজীর ও তাঁর পরিবারের নামে দখল হওয়া ২৫ একর জমি গত ৪ জুলাই জেলা প্রশাসন জিম্মায় নেয়। ওই সময় বেনজীরের নামে জমি দখলদারেরা পূর্ববেতছড়ার দখল করা জমি ফেলে চলে যায়। জমি দখলমুক্ত হওয়ার পর সেখানে পাড়া স্থাপন করা হয়। তবে আইজিপি বা অন্য কারও নামে ওই এলাকায় কোনো জমি ইজারা নেওয়া হয়নি। কারও মালিকানাও নেই।
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার (এসপি) শহিদুল্লাহ কাওছার প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদা দাবি ও জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে সাবেক আইজিপির জমি দখল নিয়ে জনশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি।
এদিকে ত্রিপুরাপল্লিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে। গত বুধবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে নিন্দা জানিয়ে বার্তা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমাও। বুধবার রাতে এক বিবৃতিতে বলা হয়, আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। এ ছাড়া সাবেক আইজিপির লোকজন এ হামলা চালিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।