একটি কক্ষের মধ্যে একটি বিছানা। বিছানাটি লাল তরলে ভেজা। ওই কক্ষের দরজা ও জানালা ছিল খোলা। পাশে আরেকটি কক্ষে রাখা ছিল কয়েকটি ছাগল। ঘরের মেঝে ও বারান্দায় ছোপ ছোপ লাল তরল। দেখে মনে হয়, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে লাল রক্ত। তবে যিনি ওই কক্ষে থাকতেন, তাঁর সন্ধান মিলছে না।
বর্ণনা দেওয়া বাড়িটি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা ইউনিয়নের পূর্বপাড় গ্রামের আবদুল হেকিমের। আবদুল হেকিমের বাড়ির ওই কক্ষে থাকতেন বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক তাইজুল ইসলাম ওরফে নাহিদ (৩৫)। সাড়ে পাঁচ বছর ধরে তিনি এ দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁর বাড়ি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বড়ভিটাবাজার গ্রামে। ১৪ বছর ধরে তিনি বিয়ানীবাজারের মাথিউরায় থেকেছেন।
গত শুক্রবার ভোরে ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের কক্ষের বিছানা, মেঝে ও বারান্দায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ আছে—এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক তাইজুলের সঙ্গে বড় কোনো হামলা বা মারামারির ঘটনা ঘটেছে এমন ভাবনা থেকেই তদন্ত শুরু করে পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশও তদন্তে যোগ দেয়। আশপাশের পুকুরে জাল ফেলেও সন্ধান চালানো হয় তাইজুলের। কিন্তু ভোর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কোনো কিছুর সন্ধান পায়নি পুলিশ। তবে একটি বিষয় নজরে আসে পুলিশের। বিছানার তোষক, বালিশসহ মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকলেও ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টায় কোনো দুর্গন্ধ বের হয়নি।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবদুল হেকিমের দুই ছেলে প্রবাসী। বাড়িতে আরও দুই ছেলে ও দুই মেয়ে থাকেন। বাড়ির দেখাশোনা করতেন তাইজুল। আবদুল হেকিমের ঘরের পাশে অন্য আধাপাকা ঘরে থাকতেন তিনি। ওই ঘরের পাশে মুরগির একটি খামারও আছে। শুক্রবার সাহ্রি খাওয়ার জন্য তাইজুলকে ডাকতে যান আবদুল হেকিমের ছেলে। তখন তাইজুলের ঘরের দরজা খোলা দেখে ভেতরে প্রবেশ করে বিছানা, মেঝেসহ বারান্দায় রক্ত দেখতে পান। পরে বিষয়টি প্রতিবেশীসহ চেয়ারম্যান ও পুলিশকে জানানো হয়। ভোরেই সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে। এ সময় তাইজুলের ব্যবহৃত কাপড় ও মুঠোফোন জব্দ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় সন্ধান চালিয়েও তাইজুলকে পাওয়া যায়নি। এ সময় রক্তজাতীয় তরল পদার্থের কোনো গন্ধ না পাওয়ার বিষয়টি নজরে আসে পুলিশের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ১৪ বছর ধরে বিয়ানীবাজারের মাথিউরা এলাকায় থাকতেন তাইজুল। স্থানীয় এক ব্যক্তিকে ধর্মের ভাই বানান তিনি। ওই ব্যক্তিকে ভুল নাম–পরিচয় দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন তাইজুল। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এরপর তাইজুল বিয়ানীবাজারের ঠিকানা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করলেও মা-বাবার নাম ঠিকই দিয়েছেন।
পুলিশ জানায়, তাইজুল কলেজ পড়া অবস্থায় বন্ধুদের সঙ্গে মারামারির সময় একজন মারা গেলে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি। প্রায় তিন বছর আগে বাবার মৃত্যু হলেও বাড়িতে পুলিশ আছে, এমন তথ্য পেয়ে আর যাননি। বিয়ানীবাজারে থাকতে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন, লেনদেন করেছেন। পুলিশের ধারণা, লেনদেনের জন্য তাইজুল এমন নাটক সাজিয়ে থাকতে পারেন।
বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম বলেন, পুলিশ ওই ঘর থেকে একটি বালতি, মগ ও কাঠি উদ্ধার করেছে। বালতি ধুয়ে ফেলা হলেও কাঠিসহ মগে কিছুটা লাল রং পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, লাল রং মিশিয়ে রক্তজাতীয় তরল বানিয়ে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হতে পারে। তিনি বলেন, তাইজুলের সন্ধান চলছে। তাঁকে পাওয়া গেলে ঘটনার বিস্তারিত জানা যাবে। উদ্ধার করা বিভিন্ন আলামত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া তাইজুলের আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।