ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যার নেপথ্যে এমপি–প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরোধ

আবাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমানকে রোববার হত্যা করা হয়।

ঝিনাইদহ জেলার মানচিত্র

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান ওরফে রিপন হত্যার ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। কেউ আটক হয়নি। তবে গতকাল দুপুরে খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাসানুজ্জামান নিহত আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে যান। তিনি হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ছাড় পাবে না বলে শোকাহত পরিবারকে জানান।

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ঠাকুর দাস মণ্ডল গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে জানান, থানায় তখনো কেউ মামলা করতে আসেনি। তাঁরা কাউকে আটক করেননি। তবে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে তিনি জানান।

এদিকে ময়নাতদন্তের পর গত সোমবার বিকেলে হাবিবুরের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি শৈলকুপার আবাইপুর ইউনিয়নের মীনগ্রামে পৌঁছায়। বিকেল পাঁচটায় গ্রামের ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল হাইসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

গত রোববার দিবাগত রাত পৌনে দুইটার দিকে আবাইপুর বাজারের কাছাকাছি এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হাবিবুর ও তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলা করে। গুরুতর আহত হাবিবুরকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

হাবিবুর আবাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং আবাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি মীনগ্রামের আবুল কালাম আজাদের ছেলে।

গতকাল হাবিবুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে অনেক মানুষের ভিড়। একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, হাবিবুর খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর বাবা আবুল কালাম আজাদ আবাইপুর রামসুন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি গত ২৬ বছর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ছয় ছেলের মধ্যে তিনজন বিসিএস কর্মকর্তা, একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, একজন ওষুধ কোম্পানির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৪ অক্টোবর মীনগ্রাম বাজারে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ঝিনাইদহ-১ (শৈলকূপা) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী নজরুল ইসলাম ওরফে দুলাল বিশ্বাসের একটি পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে কে বা কারা। এই নিয়ে নজরুল ইসলামের সমর্থকদের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের সমর্থকদের বিরোধ দেখা দেয়। এ ঘটনায় পুলিশ উভয় পক্ষের চারজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।

পরে রোববার সন্ধ্যায় ও রাতে উভয় পক্ষ শৈলকুপা থানায় দুই দফা বৈঠকও করে। কিন্তু মীমাংসা হয়নি সেই বৈঠকে। রাত পৌনে দুইটার দিকে উভয় পক্ষ থানা থেকে বেরিয়ে যায়। আটক চারজনকেও থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। থানার বৈঠক থেকে ফেরার পথে রাতে আবাইপুর বাজার পার হতেই ওত পেতে থাকা প্রতিপক্ষের লোকজন হাবিবুর ও তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলা করেন।

গ্রামের লোকজন জানান, নিহত হাবিবুর স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাইয়ের সমর্থক ছিলেন। পাশাপাশি হাবিবুর আবাইপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার হোসেন মৃধার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে সংসদ সদস্য হাইয়ের পক্ষ নিয়ে কাজ করেছেন। তবে মাঝে উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে সংসদ সদস্য হাইয়ের সঙ্গে মুক্তারের মনোমালিন্য দেখা দেয়। এই সময় নৌকার প্রার্থী হয়েও ইউপি চেয়ারম্যান পদে প্রতিযোগিতা করে মুক্তার তিন দফা পরাজিত হন।

এতে কিছুটা মন খারাপ নিয়ে দলের মধ্যে কোণঠাসা ছিলেন মুক্তার মৃধা। ওই তিন দফায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ যাঁরা করেন, তাঁরা ছিলেন ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম ওরফে দুলাল বিশ্বাসের সমর্থক। তিন ইউপি নির্বাচনে অনুসারীরা জয়লাভের মাধ্যমে নজরুল এলাকায় প্রভাব তৈরি করেন।

তিনি এবার এই আসনে সংসদ সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশী, যা নিয়ে হাইয়ের সঙ্গে দুলালের বিরোধ শুরু হয়েছে। এই বিরোধে মুক্তারের ভূমিকা তেমন না দেখা গেলেও হাবিবুর ছিলেন হাইয়ের পক্ষের সক্রিয় কর্মী। যে কারণে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি গ্রামবাসীর। গ্রামবাসী এই হত্যার বিচার দাবি করেছেন।