দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম জেলার ১৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। নির্বাচনে দলের প্রতীক চান সাবেক সংসদ সদস্যদের স্ত্রী ও সন্তানেরাও। কিছু কিছু আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যদের চিন্তা বাড়িয়েছেন এসব আগ্রহী প্রার্থীরা।
এবারের নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। এই অবস্থায় দলীয় প্রতীক নৌকা পেলেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া অনেক সহজ মনে করছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তাই দলের মনোনয়ন পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই।
চট্টগ্রাম জেলায় ১৬টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এর মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ১৪ প্রার্থী। বাকি দুটি আসনের মধ্যে চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তরীকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মনোনয়ন ফরম বিক্রি গত মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের বিপরীত আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে ২৩০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। আবার অনেকের ঠিক মনোনয়ন পাওয়া লক্ষ্য নয়। তাঁদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দলের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যাতে ভবিষ্যতে পথ সহজ হয়।
জানতে চাইলে মহানগর ১৪ দলের আহ্বায়ক ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, বড় দল হিসেবে অনেকে দলীয় ফরম নেবেন এটা স্বাভাবিক। সবার মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে। আমিও দুটি আসন থেকে মনোনয়ন নিয়েছি। তবে দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্ত সবার কাছে শিরোধার্য। মনোনয়ন ঘোষণার পর সবাই নৌকার পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। খোরশেদ আলম চট্টগ্রাম-১০ ও চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছেন।
নির্বাচনের মাঠে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও পেশাজীবীরা
নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী, হালিশহর, ডবলমুরিং, খুলশী) আসনে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে দলীয় প্রতীক চান সাবেক ফুটবল খেলোয়াড় সত্যজিৎ দাশ রুপু।
মনোনয়ন দৌড়ে নেমেছেন পেশাজীবীরাও। চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চান সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম মাসুদ আলম চৌধুরী। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন নিয়েছেন চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে। একই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান দৈনিক পূর্বদেশ-এর সম্পাদক ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুজিবুর রহমান। চট্টগ্রাম-৯ (কেতোয়ালি-বাকলিয়া) বিএফইউজের (বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন) একাংশের সাবেক সহসভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আব্দুল কৈয়ূম চৌধুরী নির্বাচন করতে চান চট্টগ্রাম-১৪ থেকে। চিকিৎসক নেতা ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আ ম ম মিনহাজুর রহমান চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে নির্বাচনে মনোনয়ন দৌড়ে আছেন।
মনোনয়ন দৌড়ে আছেন স্বজনেরাও
চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের ১৩ সংসদ সদস্য মনোনয়ন ফরম নিলেও একমাত্র তিনি ফরম নেননি। তবে তাঁর পরিবর্তে ছেলে মাহবুব উর রহমান।
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার। তিনি বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও) আসনে আওয়ামী লীগের প্রতীকে নির্বাচন করতে চান প্রয়াত সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদের মেয়ে কাজী শারমিন সুমি এবং আরেক প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদলের স্ত্রী সেলিনা খান। চট্টগ্রাম-৯ আসনে নির্বাচনে করতে চান নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও প্রয়াত মন্ত্রী এম এ মান্নানের ছেলে ও নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম। চট্টগ্রাম-১০ আসনের জন্য ফরম নিয়েছেন প্রয়াত সংসদ সদস্য আফছারুল আমীনের ছেলে মো. ফয়সাল আমীন ও ভাই মো. এরশাদুল আমীন। চট্টগ্রাম-১৪ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আফসার উদ্দিন আহমদের ছেলে ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদও ফরম নিয়েছেন।
আছেন উপজেলা চেয়াম্যান, ওয়ার্ড কাউন্সিলররা
তাঁদের কেউ উপজেলা চেয়ারম্যান, কেউ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এই পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না নিজেদের। এবার তাঁদের লক্ষ্য আরও বড়। হতে চান সংসদ সদস্য।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলামও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তিনি চট্টগ্রাম-২ থেকে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে নির্বাচিত নেতারা অবশ্যই দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। আমিও চেয়েছি। তবে পদত্যাগ এখনই বাধ্যতামূলক নয়। মনোনয়ন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেওয়ার আগে পদত্যাগ করলেই হবে।
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতে ইতিমধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়েছেন পটিয়ার মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, সীতাকুণ্ডের এস এম আল মামুন ও বাঁশখালী উপজেলার চৌধুরী মোহাম্মদ গালিব সাদলী। মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব, ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাত ওয়ার্ড কাউন্সিলরও দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। তাঁরা হচ্ছেন সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও রামপুর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সবুর, পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শহিদুল আলম, দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের ছালেহ আহম্মদ চৌধুরী, উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের নিছার উদ্দিন আহমেদ, পশ্চিম শুলকবহর ওয়ার্ডের মো. মোবারক আলী, দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের জিয়াউল হক, দক্ষিণ পাঠানটুলী ওয়ার্ডের নজরুল ইসলাম বাহাদুর।
সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন রেখা আলম চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১১), নগর আওয়ামী লীগের সদস্য বিজয় কুমার চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৮), কফিল উদ্দিন, আবুল ফজল কবির আহমদ উল্লেখযোগ্য।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ ও মো. মোবারক আলী বলেন, একজন রাজনৈতিক কর্মীর ইচ্ছা থাকে সংসদ সদস্য হওয়ার। আর তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এলাকার উন্নয়নে কাজ করে আসছেন। সংসদ সদস্য হতে পারলে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারবেন।
তীব্র লড়াই যে আসনে
চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি বাকলিয়া) আসনটি হচ্ছে শহরের মূল নির্বাচনী এলাকা। এই আসনের দিকে সব সময় দৃষ্টি থাকে নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের। একসময় এখানে নির্বাচন করেছিলেন নগর কমিটির প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরে ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন তখনকার কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মহিউদ্দিনপুত্র শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
মহিবুলের পাশাপাশি নগর আওয়ামী লীগের আরও ৮ নেতা দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। আ জ ম নাছির পাশাপাশি চট্টগ্রাম-১০ ও চট্টগ্রাম-১১ থেকেও মনোনয়ন নিয়েছেন। এ ছাড়া নগর কমিটির দুই সহসভাপতি সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ও ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরীও ৯ আসনের দৌড়ে রয়েছেন। তবে মনোনয়নের লড়াই মূলত মহিবুল ও নাছিরের মধ্যে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নগর আওয়ামী লীগে বর্তমানে এই দুই নেতার নামে দুটি ধারা বিবদমান।