রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিবের ছাত্রত্ব থাকা না–থাকা নিয়ে নানা আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। গালিব দাবি করতেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষার্থী। তবে ওই বিভাগ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, গালিব এই বিভাগের শিক্ষার্থী নন। তাঁর দেওয়া স্নাতকের সনদে অসংগতি থাকায় গত সেপ্টেম্বরে গালিবের ভর্তি বাতিল করা হয়েছে।
শুধু তা–ই নয়, প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর তিনি স্নাতক প্রথম বর্ষও পেরোতে পারেননি। প্রথম বর্ষে ‘ডিসকলেজিয়েট’ হয়ে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। পরের দুই বছর পরীক্ষা দিয়েও কৃতকার্য হতে না পেরে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র প্রথম আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে ছাত্রলীগ নেতা গালিব ছাত্রত্বের ভুয়া পরিচয় দেন বলে খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনেকে প্রশ্ন তোলেন, গালিব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও কীভাবে ছাত্রলীগের মতো বৃহৎ একটা প্রগতিশীল সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গালিব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। প্রথম বর্ষে “ডিসকলেজিয়েট” হয়ে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। পরের দুই বছর পরীক্ষা দিয়েও কৃতকার্য হতে না পেরে ছাত্রত্ব হারান।’
‘এ কেমন জালিয়াতি’ প্রশ্ন তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কি এতটা দেউলিয়া আর মেধাশূন্য হয়েছে যে সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্সের একজন অনিয়মিত ছাত্রকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক বানাতে হবে? রাজনীতি যেমন আর এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, তেমনি মনে হয় ছাত্ররাজনীতিও আর ছাত্রদের হাতে নেই। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে এই ভুয়া ছাত্রটিকে আবাসিক হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “পারসোনা নন গ্রাটা” (অবাঞ্ছিত) ঘোষণা করবেন।’
২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্য মাস্টার্স প্রোগ্রামের জরুরি সভায় আসাদুল্লা-হিল-গালিবের ভর্তি বাতিলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আসাদুল্লা-হিল-গালিব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পেরে ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন। পরে তিনি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্সের ছাত্র বলে দাবি করতেন। এই পরিচয় দেখিয়ে গত বছরের অক্টোবরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গালিব ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভুয়া সনদ’ দেখিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির আবেদন করেছিলেন। সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে গালিবের ছাত্রত্ব নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে গতকাল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে। বিভাগটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, মো. আসাদুল্লা-হিল-গালিব গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্য মাস্টার্স প্রোগ্রামের জুলাই ২০২১ সেশনের ছাত্র (আইডি নম্বর: ২৩১০০৪৬২১০) হিসেবে ভর্তির আবেদন করেছিলেন। তবে তাঁর জমা দেওয়া স্নাতকের সনদে অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। পরে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিষয়টি যাচাই করে ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বিভাগের সান্ধ্য মাস্টার্স প্রোগ্রামের জরুরি সভায় ভর্তি বাতিলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে গালিব এই বিভাগের শিক্ষার্থী নন। ভবিষ্যতে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যেন তথ্যগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সংবাদকর্মীদের যত্নশীল থাকতে বলা হয়।
আবাসিক হল সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও আসাদুল্লা-হিল-গালিব দাপটের সঙ্গে বর্তমানে দুটি হলে একাধিক আসন দখলে রেখেছেন। তিনি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের চার আসন বিশিষ্ট ২২৮ নম্বর কক্ষে একাই থাকেন। এ ছাড়া মাদার বখ্শ হলের চার আসন বিশিষ্ট ২১৫ নম্বর কক্ষও দখলে রেখেছেন। এই কক্ষে তিনি মাঝেমধ্যে এসে রাত কাটান।
ছাত্রত্বের ব্যাপারে জানতে চাইলে মো. আসাদুল্লা-হিল-গালিব গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিছু জানা নেই। আমার কাছে বিভাগের প্রত্যয়নপত্র আছে।’
ভুয়া ছাত্রত্ব পরিচয় দেওয়ায় গালিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘সব ধরনের তথ্যই আমাদের কাছে আছে। আমাদের সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যদি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দর করতে চাই। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
এ ব্যাপারে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক সাহিদুল ইসলাম শাকিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারাও অবহিত আছেন। খুব দ্রুতই আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব। ছাত্রলীগে কোনো অছাত্রের নেতা হওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’