বগুড়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানাসহ ১৬০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে করা যুবদল নেতা ফোরকান আলী হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের জন্য পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছেন তাঁর বাবা আবদুল কুদ্দুস। সেই সঙ্গে এই হত্যা মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী রোববার বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (শাজাহানপুর) আমলি আদালতে আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন।
আবদুল কুদ্দুস অভিযোগ করেছেন, তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ এই হত্যা মামলা করেননি। মামলাটি অন্য একজন মিথ্যা তথ্য দিয়ে করেছেন। সেই সঙ্গে সেই বাদী ও তাঁর সাক্ষীরা এই মামলায় বিভিন্নজনকে আসামি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। মামলায় ফোরকানকে ‘গুলি করে হত্যা’র কথা বলা হলেও গুলির কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন তাঁর বাবা। তিনি বলেন, ফোরকান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আবদুল কুদ্দুস বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের ঘাসিড়া সুফিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর ছেলে নিহত ফোরকান আলী ওই ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসের একটি কারখানার কর্মী ছিলেন।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সকালে শাজাহানপুরের সাজাপুর এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে বিএনপির অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়। ওই মিছিলে খোট্টাপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ফোরকান আলীও অংশ নেন। এ সময় পুলিশ ও র্যাবের টহল দল অবরোধকারীদের ধাওয়া দেয়। ফোরকান আলী মোটরসাইকেলে পালানোর সময় সাজাপুর-ফুলতলা মাদ্রাসার পেছনের সড়কে গিয়ে পড়ে যান। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার ১১ মাস পর ১ নভেম্বর বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (শাজাহানপুর) আমলি আদালতে শাজাহানপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাজেদুর রহমান, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা নুরুজ্জামানসহ ১৬০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ফোরকানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
এ মামলাটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা হয়েছে বলে ফোরকান আলীর বাবা আবদুল কুদ্দুস বগুড়ার পুলিশ সুপারের কাছে ৫ নভেম্বর লিখিত অভিযোগ করেছেন। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়ায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁর ছেলে ফোরকান আলীর হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে। এ মৃত্যুতে কারও প্রতি অভিযোগ না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই ফোরকানকে দাফন করা হয়। অথচ পরিবারকে না জানিয়ে বা কোনো প্রকার আলাপ–আলোচনা না করেই ইউনুস আলী চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আদালতে মামলা দায়েরের পর থেকেই বাদী ইউনুস আলী আসামিদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি, এমনকি অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে অনেককে মামলায় ফাঁসানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করছেন।
হৃদ্রোগে মৃত্যুকে গুলি করে হত্যা বলে চালিয়ে দিয়ে সাজানো মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত এবং চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবদুল কুদ্দুস পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জানান। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আদালতে গিয়েছিলেন। আদালত ফোরকানের হৃদ্রোগে মৃত্যুর কাগজপত্র চেয়েছেন। সেসব কাগজপত্র গুছিয়ে রোববার শাজাহানপুর আমলি আদালতে তিনি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করবেন।
ফোরকানের ছোট ভাই ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর ভাই খোট্টাপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। হৃদ্রোগে মৃত্যু হওয়ায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাশ দাফন করা হয়েছে। মামলার বাদী ইউনুস আলী আমাদের কোনো আত্মীয় নন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সব সময় আমার ভাইয়ের বিরোধিতা করেছেন তিনি। আমার ভাইকে হত্যা করা হলে পারিবারিকভাবে আমরাই মামলা দায়ের করতাম। অথচ পরিবারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা না করে বা ন্যূনতম জানানোর প্রয়োজন মনে না করেই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সুযোগে ইউনুস আলী বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ঢালাও মামলা করেছেন। গুলির কোনো ঘটনা না ঘটলেও আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলায় মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। মামলাকে পুঁজি করে তিনি এবং মামলার সাক্ষী শফিকুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান এখন চাঁদাবাজি করছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের জন্য আমার বাবা পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছেন।’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা প্রথম আলোকে বলেন, ফোরকানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে মামলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মামলার পরবর্তী কার্যক্রম চলমান আছে। ফোরকানের বাবা আবদুল কুদ্দুস মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের একটি আবেদন দিয়েছেন। যেহেতু আদালতে মামলা হয়েছে, এখন তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের আদেশও আদালত থেকেই আসতে হবে। মামলার বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকলে আবদুল কুদ্দুসকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চাঁদাবাজির কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে শাজাহানপুর থানায় মামলা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মামলার বাদী ও শাজাহানপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরিবারকে না জানিয়ে আদালতে ফোরকান হত্যা মামলা দায়ের প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে, ‘দলীয় সিদ্ধান্তেই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। দলীয় নেতাদের নির্দেশ মেনে আমি এই মামলার বাদী হয়েছি।’ পরিবারের মতামত নিয়েই মামলা দায়ের করা হয়েছে দাবি করে ইউনুস আলী আরও বলেন, কারও চাপে পড়ে হয়তো এখন ফোরকানের বাবা পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের আবেদন দিয়েছেন। তা ছাড়া চাঁদাবাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন।
চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে মামলাটির সাক্ষী ও ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবরোধের মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় যুবদল নেতা ফোরকানের মৃত্যু হয়েছে। গুলিতে মৃত্যু হয়নি। মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার প্রয়োজন হলে একই সাক্ষ্য দেব। মামলাকে পুঁজি করে কারও কাছ থেকে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।’
ফোরকানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে করা মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে সারা দেশে এক দফা দাবি আদায়ে সরকারবিরোধী গণ-আন্দোলন চলাকালে ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক সকাল সোয়া সাতটায় শাজাহানপুর উপজেলার ফুলতলা মাদ্রাসা মাঠ থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করা হয়। তাতে যুবদল নেতা ফোরকান আলীসহ ৪০০-৫০০ নেতা-কর্মী অংশ নেন। মিছিল নিয়ে তাঁরা শাজাহানপুর উপজেলা সদরের দিকে যাওয়ার উদ্দেশে মহাসড়কে ওঠামাত্র আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নাম উল্লেখ করা আসামিসহ ৪০০-৫০০ অজ্ঞাতনামা আসামি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের প্রত্যক্ষ উসকানি, মদদে, নির্দেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ট্রাক ভাড়া করে মিছিলে পথরোধ করেন। আসামিরা রিভলবার, পিস্তল, রড, দেশীয় বন্দুক, ককটেল, হাতবোমা, রামদা, চায়নিজ কুড়াল, লাঠিসোঁটা ইত্যাদি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিলেন। আসামিরা ট্রাকের ওপর থেকে বিএনপির শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা, গুলিবর্ষণ ও ককটেল হামলা করেন। এতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটির একপর্যায়ে আসামি উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা নুরুজ্জামান যুবদল নেতা ফোরকান আলীকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। ফোরকান আলীর বুকে ও পেটে গুলি লাগলে তিনি মাটিতে লুটে পড়েন। আসামিরা গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। রক্তাক্ত অবস্থায় ফোরকান আলীকে দ্রুত রিকশাভ্যানযোগে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
আরজিতে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করায় এবং আওয়ামী লীগ প্রশাসনের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে ওই সময়ে মামলা করা সম্ভব হয়নি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পদত্যাগের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় এবং থানা-পুলিশের কার্যক্রম নতুনভাবে শুরু হওয়ায় তাঁর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনা করে আদালতে মামলা দায়ের করা হলো।
মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত ও লাশ উত্তোলন না করার জন্য বগুড়ার পুলিশ সুপারের কাছে আবেদনে ফোরকান আলীর বাবা আবদুল কুদ্দুস উল্লেখ করেছেন, তাঁর ছেলে ফোরকান আলী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফোরকান স্বৈরাচারী সরকারের প্রহসনের নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর অবরোধ আন্দোলন চলাকালে পুলিশ ও বিজিবির ধাওয়ায় রাস্তায় হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।
ফোরকানের মৃত্যু নিয়ে আদালতে ১৬০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলার আবেদন করা হয়। আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য শাজাহানপুর থানা-পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার বাদী ইউনুস আলী পরিবারকে না জানিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কু-উদ্দেশ্যে এই মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা খোট্টাপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য শফিকুল ইসলাম, থানা বিএনপির সদস্য জিল্লুর রহমান এবং উপজেলা যুবদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলী পরস্পর যোগসাজশে এই মামলা দায়ের করে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করছেন।
আবদুল কুদ্দুস উল্লেখ করেন, ‘আমার ছেলের লাশ কবর থেকে উত্তোলনে পরিবারের সম্মতি নেই। এ কারণে মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত এবং ময়নাতদন্ত না করার আবেদন জানাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে কথা হলে শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়াদুদ আলম বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পাঁচ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।’ তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের আবেদনের বিষয়ে ওসি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলবে। আদালত মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দিলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’