আগের মতো আর শরীর চলে না। কথা জড়িয়ে আসে। লাঠি ছাড়া হাঁটতেও পারেন না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে খুব একটা বের হন না। নানা ধরনের অসুখ শরীরে বাসা বেঁধেছে। কানে কম শুনলেও স্মৃতি সজীব। ৮৭ বছর ছুঁই ছুঁই ভাষাসংগ্রামী মো. আবদুল আজিজ অবলীলায় ৭১ বছর আগের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। তাঁর কণ্ঠে বায়ান্নর তেজ এখনো অটুট।
সিলেট নগরের কুমারপাড়া এলাকায় ভাষাসংগ্রামী, লেখক ও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য মো. আবদুল আজিজ স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বসবাস করেন। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। সিলেট শহর থেকে দূরে ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর এবং সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কেমন করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল, আলাপচারিতায় তিনি সেসব জানান।
ভাষা আন্দোলনের সময়ে মো. আবদুল আজিজ তাজপুরের মঙ্গলচণ্ডী হাইস্কুল থেকে দশম শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখনই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধে।
আবদুল আজিজ বলেন, ‘আগে থেকেই আমি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম, তাই সিলেট শহরের অনেক নেতার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক ছিল। তাঁরাই আমাকে ভাষা আন্দোলন–সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জানাতেন। তাঁদের পরামর্শেই স্থানীয়ভাবে তাজপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালন করি।’
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে মঙ্গলচণ্ডী হাইস্কুলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেন আবদুল আজিজ। এ কাজে তাঁকে পরামর্শ দেন রাজনীতিবিদ আবদুল বারি। সেদিন ছাত্রদের উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘটও পালিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ্দর আলীর মাধ্যমে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিলরত ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা তিনি জানতে পারেন। পরের দিন বিদ্যালয় খোলার আগেই তাঁরা একটি ছাত্রসভার আয়োজন করেন। এ সভা মো. আবদুল আজিজ পরিচালনা করেন।
২২ ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সভায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি তাজপুরে আরেকটি ছাত্রসভা হয়। সে সভায় আবদুল আজিজ নওবেলাল ও সৈনিক পত্রিকা থেকে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ পাঠ করে শোনান। সভাটি স্থানীয়ভাবে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপরই পুলিশ ছাত্রসভার সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা শুরু করে।
এত বছর পর ওই দিনগুলোর মূল্যায়ন কীভাবে করবেন? জিজ্ঞেস করলে আবদুল আজিজ বলেন, ‘তাজপুরের মতো একটি মফস্সল এলাকায়ও ভাষা আন্দোলনের ঢেউ আমরা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম। সেটাই বা কম কী? তাজপুরে হাটবারে আমরা সভা করতাম। ছাত্রদের পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আমরা ছড়িয়ে দিয়েছি। এসব ভাবলে এখন মনে তৃপ্তি লাগে। তবে আক্ষেপ লাগে তখনই, যখন দেখি, দেশে এখনো বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বত্র প্রচলন ঘটেনি।’