ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের পর ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর এলাকার ঘরে ঘরে পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১২ দিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। ফলে চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন স্থানীয় লোকজন। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার ঢালচর এলাকা ঘুরে ভুক্তভোগী লোকজন, চারজন পল্লিচিকিৎসক, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের (সিএইচসিপি) সঙ্গে কথা বলে এমন পরিস্থিতির কথা জানা যায়।
চরফ্যাশন উপজেলার দুর্গম ইউনিয়ন ঢালচরে দুই শতাধিক পুকুর আছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় এসব পুকুর জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে পানি লবণাক্ত হয়ে যায়। অনেক পুকুরের পাড় ভেঙে নদীর সঙ্গে সরাসরি নালা সৃষ্টি হওয়ায় এখন নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে। পুকুর ও খালের পানি ছাড়াও ঢালচরের তিন দিকে নদী ও একদিকে সাগর হওয়ায় ঢালচরবাসীকে বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। রোগের মধ্যে আছে অ্যালার্জি, জ্বর, পাতলা পায়খানা ও আমাশয়। ঢালচরের আনন্দবাজারের বাসিন্দা মাইনুদ্দিন মাঝি বলেন, তাঁর ছেলে ছাব্বির হোসেনের (১০) চুলকানি ও জ্বর। ওষুধ খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, ঢালচরে প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসবাস। ১২-১৩ দিন আগে এখানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হেনেছে। এরই মধ্যে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। চরের মানুষের ঘরে ঘরে জ্বর, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া ও অ্যালার্জি দেখা যাচ্ছে। কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। নেই কমিউনিটি ক্লিনিকও। বারবার বলা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কেউ কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
সরেজমিনে জানা যায়, একসময় ঢালচরের মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষি। কৃষকেরা জাল ও বড়শি পেতে নদী থেকে মাছ শিকারও করতেন। তখন ঢালচরের চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে উঁচু মাটির ঢিবি ছিল। স্থানীয় লোকজনের কাছে এই ঢিবি ‘দেল’ বলে পরিচিত ছিল। তখন বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস ছাড়া সাধারণত ‘দেল’ উপচে লোকালয় প্লাবিত হতো না। এ জন্য তখন ঢালচরে তেমন গভীর নলকূপ না থাকলেও লোকজন জমিতে ছোট ছোট কূপ খনন করে পানির ব্যবস্থা করতে পারতেন। পরে পুকুর ও গভীর নলকূপ বেড়েছে। কিন্তু সুপেয় পানির উৎস বাড়ার বদলে কমেছে। নদীভাঙনে কৃষিজমি একের পর এক বিলীন হয়েছে। একপর্যায়ে কৃষকেরা হয়ে গেছেন জেলে। সবাইকে এখন মাছ শিকারে নদী ও সাগরে যেতে হচ্ছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানায় ঢালচর প্লাবিত হয়ে লবণাক্ত পানিতে ছেয়ে গেছে চারপাশ। আর এতেই দেখা দিয়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ।
ঢালচর ইউনিয়নের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মো. শরীফুল ইসলাম সওদাগর বলেন, ঢালচরে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। এখন ধরতে গেলে একটিরও কার্যক্রম নেই। কারণ, তিনটি ক্লিনিক নদীভাঙন বিলীন হয়ে গেছে। শেষ ক্লিনিকটি তিনি পরিচালনা করতেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের একটি কক্ষে। সেখানেও ঘূর্ণিঝড় রিমাল দুর্গত মানুষের মালামাল এমনভাবে রাখা হয়েছে, সেখানে চিকিৎসা দেওয়া মতো অবস্থা নেই। এ দিকে ঢালচরে অতিরিক্ত লবণ পানিতে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত গরমেও মানুষ অতিষ্ঠ। ঘরে ঘরে এখন পানিবাহিত রোগে ধুঁকছে মানুষ। জরুরি চিকিৎসক দল গঠন করা উচিত। পুকুরভর্তি লবণপানি পরিবর্তন ছাড়াও পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বিতরণ করা প্রয়োজন।
নদীভাঙনে কৃষিজমি একের পর এক বিলীন হয়েছে। একপর্যায়ে কৃষকেরা হয়ে গেছেন জেলে। সবাইকে এখন মাছ শিকারে নদী ও সাগরে যেতে হচ্ছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানায় ঢালচর প্লাবিত হয়ে লবণাক্ত পানিতে ছেয়ে গেছে চারপাশ। আর এতেই দেখা দিয়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ।
ঢালচরে চারজন পল্লিচিকিৎসক আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রবীণ পল্লিচিকিৎসক মফিজুল ইসলাম ও মো. ইকবাল হোসেন জানান, তাঁদের এলাকায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগী পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। লবণ পানির কারণে ঢালচরে এখন অতিরিক্ত গরম পড়েছে।
বৃহস্পতিবার ও গতকাল ঢালচরে ঘুরে কিছু পুকুরের পাড় ভাঙা দেখা যায়। ভাঙা অংশের সঙ্গে নদীর জোয়ারের লবণাক্ত পানির সংযোগ তৈরি হয়েছে। জোয়ারের সময় পথঘাট লবণপানিতে ভেসে যাচ্ছে। ঢালচরের আনন্দবাজার, আদর্শপাড়া, ভদ্রপাড়াসহ পূর্বাংশে দুই শতাধিক পরিবারের বাস। তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের কারণে-অকারণে লবণপানিতে নামতে হচ্ছে। ঘরের শিশু-নারীরাও থালাবাসন ধোয়ার কাজ করছেন লবণপানিতে। গভীর নলকূপের পানিতে গোসল ও রান্নার কাজ সারলেও অন্য কাজে লবণপানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। একমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিকটি জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে খাদের পাড়ে কাত হয়ে পড়ে আছে। সেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ। স্থানীয় বেশির ভাগ মানুষের গায়ে ঘামাচি ও ফোঁড়ার মতো উঠেছে। চুলকাতে চুলকাতে তাঁদের অবস্থা খারাপ।
ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী সময়ে প্রভাব থাকে। সুপেয় পানির শূন্যতা দেখা দেয়, পানির ঘনত্ব বাড়ে। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগগুলো বাড়ে। পেটব্যথা ও বমি হতে পারে আর লবণপানির কারণেও শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।শোভন কুমার বসাক, চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা
ঢালচরের আনন্দবাজারের বাসিন্দা মো. মাহে আলমের তিন সন্তান। ১০ বছর বয়সী ছেলে মোজাহিদুল ইসলামের জ্বর ও চুলকানি। পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে বিবি আয়েশার জ্বর, সর্দি-কাশি ও চুলকানিতে অস্থির হয়ে উঠেছে। মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, হাফিজি মাদ্রাসায় পড়া তাঁর ৯ বছর বয়সী ছেলে মো. রাসেলের কয়েক দিন ধরে অতিরিক্ত জ্বর। ওষুধ খাওয়ালে জ্বর কমলেও আবার বেড়ে যায়।
ঢালচরের প্রবীণ বাসিন্দা বাৎসু ফরাজি, নাজিম পাটওয়ারী ও মো. কাওসার জানান, ৫০-৫৫ বছর আগে তাঁরা এ চরে যৌবনের শুরুতে এসেছেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের মতো উঁচু ঢেউ আর জলোচ্ছ্বাস তাঁরা দেখেননি। আর পানিও এমন বিষাক্ত লবণ ছিল না। এই পানি পুকুর থেকে দ্রুত না সরাতে পারলে এলাকার মানুষের রোগ-শোক কমবে না।
চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা শোভন কুমার বসাক বলেন, ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী সময়ে প্রভাব থাকে। সুপেয় পানির শূন্যতা দেখা দেয়, পানির ঘনত্ব বাড়ে। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগগুলো বাড়ে। পেটব্যথা ও বমি হতে পারে আর লবণপানির কারণেও শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রোগ-শোক বৃদ্ধি পায়। এখন তাঁদের অনেক করণীয় আছে, কিন্তু ঢালচরের সব কমিউনিটি ক্লিনিক নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তবে ওই এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে একটি চিকিৎসক দল পাঠানোর চেষ্টা করবেন তিনি।