করতোয়ায় নৌকাডুবি

চার মাসের মধ্যে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতির এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছেন লোকজন। গত শনিবার দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে টইটম্বুর করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট। নৌকায় পারাপার হচ্ছেন লোকজন। অতিরিক্ত যাত্রী পারাপার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন দুজন গ্রাম পুলিশ। নৌকায় তিনটি লাইফ জ্যাকেট রয়েছে। তবে মাঝি বা যাত্রীদের কেউ তা পরেননি। গত শনিবার দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া-বামনহাট ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।

গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর এই ঘাটে নৌকা ডুবে ৭২ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর ঘাটের ইজারাদার বদলে গেছেন। তৈরি করা হয়েছে নতুন নৌকা। তবে ঘাটের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আর নৌকাডুবির পর জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চার মাসের মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হওয়া হবে। তবে এক বছর পরও সেখানে সেতু নির্মাণের দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখা যায়নি।

এ সম্পর্কে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) পঞ্চগড় কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ জামান বলেন, ‘আউলিয়ার ঘাটে ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ‘ওয়াই’ আকৃতির সেতু নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নও সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পার্চেজ কমিটির অনুমোদন পেলেই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। আশা করছি, এক মাসের মধ্যেই এই অনুমোদন পাওয়া যাবে।’

গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়। এখনো নিখোঁজ আছেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৩) নামের এক ব্যক্তি। তিনি বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম

নৌকাডুবির চার দিন পর ২৯ সেপ্টেম্বর নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের অর্থ ও ত্রাণসহায়তার অনুষ্ঠানে রেলপথমন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, আউলিয়ার ঘাটে ইতিমধ্যে ব্রিজ (সেতু) হওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এটি এখন নকশা করার পর্যায়ে আছে। নকশার কাজ শেষ হয়ে গেলে দরপত্র হবে। আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে এর বাস্তবভিত্তিক কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

গত শনিবার আউলিয়ার ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে নদীর পানি বেড়েছে। দুজন সহযোগীকে নিয়ে নৌকা চালাচ্ছেন ঘাটের ইজারাদার আবদুর রাজ্জাক (৩৯)। জনপ্রতি পারাপারের জন্য নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। এ ছাড়া মোটরসাইকেল ও ভ্যান পারাপারের জন্য নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা করে। বোদা উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে প্রায় তিন মাস ধরে মাড়েয়া-বামনহাট, সাকোয়া ও বড়শশী—এই তিন ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ সদস্যরা পর্যায়ক্রমে সেখানে পাহারা দিচ্ছেন। নৌকায় অতিরিক্ত কোনো যাত্রী যেন না ওঠেন, তা দেখার দায়িত্ব তাঁদের। গ্রাম পুলিশের এক সদস্য একরামুল হক জানান, নৌকায় প্রতিবারে ২০ জন ও পাঁচটি মোটরসাইকেল পারাপারের অনুমতি রয়েছে।

ইজারাদার আবদুর রাজ্জাক জানান, বর্ষা মৌসুমের আগে নদীর পানি কমে যাওয়ায় নৌকা চলাচল বন্ধ ছিল। তখন বাঁশের সাঁকোতে মানুষ পারাপার করা হয়েছিল। পানি বাড়ার পর নৌকা চালু করা হয়েছে। এবার ৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা দিয়ে ঘাট ইজারা নিয়েছেন তিনি। তবে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে তৈরি করেছেন নতুন নৌকা, ৭০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন নতুন স্যালো মেশিন। সবকিছু মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাঁর। আবহাওয়া ভালো থাকলে যাত্রী পারাপার করে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আয় হয়। ইজারা দেওয়ার পর জেলা পরিষদ থেকে ঘাটের কোনো উন্নয়নকাজ কার করা হয়নি।

এদিকে আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনার প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর নৌ অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলায় গত ১৪ মার্চ তৎকালীন ঘাট ইজারাদার আবদুল জব্বার (৫৮) ও নৌকার মাঝি বাচ্চু মিয়াকে (৫২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তাঁরা কারাগারে আছেন। এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নৌ অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) আদালত-২ ও ভারপ্রাপ্ত নৌ আদালতে আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলার অপর আসামি হলেন আরেক মাঝি রবিউল ইসলাম। তবে বর্তমানে তিনি পলাতক।

মাড়েয়া এলাকার বাসিন্দা এজামুল হক (৪৭) আক্ষেপ করে বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছি এখানে ব্রিজ হবে। বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এরপর আমরাও অনেক মাপজোখ দেখেছি। কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় কি ব্রিজ দেখা পাব? একটা ব্রিজের অভাবে তিনটা ইউনিয়নের হাজারো মানুষের কষ্ট কি শেষ হবে না?’