দেশের খ্যাতিমান গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক হাসিনা খান বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। নিজেদের দেশে পিএইচডি করতে হবে। দেশে পিএইচডি করাটা জরুরি। অনেকেই দেশে পিএইচডির মান নিয়ে প্রশ্ন করেন। মান ঠিক করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়কে সেটি নির্ধারণ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য দেশে গবেষণা হওয়া জরুরি।’
আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টেডএক্স-চিটিগাং ইউনিভার্সিটি’ শিরোনামের এক আন্তর্জাতিক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন গবেষক হাসিনা খান। বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদে মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। ‘চিটাগাং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড হায়ার স্টাডি সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল—‘একটি নতুন আগামী’। দেশের খ্যাতিমান আট ব্যক্তি নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেন অনুষ্ঠানে।
পাট ও ইলিশের জীবনবিন্যাস আবিষ্কারে যুক্ত গবেষক হাসিনা খান আরও বলেন, ‘পাট আমাদের আইডেন্টিটি (পরিচয়)। এটি শুধু অর্থকরী ফসল নয়, তন্তু দেওয়া ফসলও নয়। এটি আমাদের দেশের আইকন। পরিবেশবান্ধব এ ফসল দেশের অর্থনীতির জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর বক্তব্য শুরু করেন সৈয়দ শামসুল হকের কথা দিয়ে। তিনি বলেন, ‘সৈয়দ শামসুল হক অসুস্থ হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, হুমায়ূন তোমাকে সেরে উঠতে হবে। কারণ, তুমি সাধারণ মানুষ নও। সাধারণ মানুষের হাতে পাঁচটা আঙুল থাকে। কিন্তু তোমার রয়েছে ছয়টি আঙুল। ষষ্ঠ আঙুলটি তোমার কলম। তোমাকে তাই সেরে উঠতে হবে এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের অনুবাদ করতে হবে।’
আনিসুল হক আরও বলেন, ‘কবি–সাহিত্যিকদের ষষ্ঠ আঙুল থাকে। তাঁদের কাজ মানুষের স্বপ্নগুলো অনুবাদ করা। জর্জ অরওয়েল নামের একজন খ্যাতিমান লেখক বলেছেন, মানুষ চারটি কারণে লেখে। এর মধ্যে এক নম্বর অহমিকা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে সৌন্দর্যের সৃষ্টি, তৃতীয়টি ইতিহাস সৃষ্টি আর চতুর্থটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আমিও এসব কারণে লিখি। এক নম্বর আমি নিজেকে ভালোবাসি, নিজেকে নায়কের আসনে দেখতে চাই। দুই নম্বর কারণ অবশ্যই আমি সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে চাই, এ জন্য লিখি; আর তিন নম্বর কারণ অবশ্যই ঐতিহাসিক দায় থেকে লিখি। এ পৃথিবীটাকে সুন্দর, সম্যক ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী হিসেবে দেখতে চাই। গাজায় যুদ্ধ হবে না, শিশুদের ওপর অযৌক্তিক হামলা চালানো হবে না, এটি আমিও বিশ্বাস করি।’
উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার বলেন, ‘ব্যর্থতার গল্প কেউ শুনতে চায় না। কারণ, ব্যর্থ লোকেরা নাকি কাউকে আশা দিতে পারে না। কিন্তু আমাদের ইতিহাসে অনেক ব্যর্থ লোকের কথা রয়েছে। আমরা সেসব গল্প পড়ি। মানুষের জীবনের সব মোটিভেশন আসে ব্যর্থতা থেকে। ব্যর্থতাই সফলতার শুরু।’
ছেলের অটিজমের উদাহরণ টেনে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বাসনা মুহুরী বলেন, ‘আমার ছেলের যখন অটিজম ধরা পড়ল, আমাকে বলা হলো সব জায়গায় যেতে, সবকিছু করতে। কিন্তু ছেলেকে যখন সাধারণ স্কুলে দিলাম, এক সপ্তাহের মধ্যে বের করে দিল। আত্মীয়ের বাসায় যখন নিলাম, প্রশ্ন করা হলো, “তোমার পাগল ছেলেকে কেন আমার এখানে নিয়ে এসেছ?” কোনো জায়গায় দাওয়াত করা হলে ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় ছেলেকে নেওয়ার জন্য নিষেধ করত। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। এখন দাওয়াত দিলে আগেই ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। কারণ, আমি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে পেরেছি।’
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বাসনা মুহুরী বলেন, ‘বিশেষ শিশুদের জন্য আমরা সুন্দর আগামী রেখে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। আপনার আশপাশে অটিজমে আক্রান্ত কোনো শিশুকে দেখলে তাঁকে পাগল বলে তাড়িয়ে না দিয়ে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করুন। কী করতে হবে, দিকনির্দেশনা দিন। কারণ, সহযোগিতা পেলে তাঁরাও আমার-আপনার মতো দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।’
এভারেস্ট বিজয়ী বাবর আলী নিজের এভারেস্ট জয়ের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করেন অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা মাউন্ট রয়েছে। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় আমাদের সেটির চূড়ায় উঠতে হবে। হিমালয় শুধু নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার জায়গা, বিষয়টি এমন নয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তন দেখারও জায়গা। কীভাবে বরফের পুরুত্ব কমে লেক তৈরি হচ্ছে, এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কারণ, দিন দিন এর সংখ্যাটা বাড়ছে।’
হালদা নদীর সম্ভাবনা ও গুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। আর নদী বাঁচাতে হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। আমরা যদি ভবিষ্যতে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ গড়তে চাই, তাহলে নদীদূষণ ও দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। রাজনীতিবিদ যাঁরা নদী দখলের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য বলে ঘোষণা করতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী নদীদূষণ কিংবা দখলের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধেও সরকারকে কঠোর হতে হবে।’
গীতিকার আসিফ ইকবাল বলেন, ‘আমাদের ইউনিক হতে হবে। সব জায়গায় আপনার থেকে ভালো লোক রয়েছে। এই কম্পিটিশনে আপনি কেন যাবেন? তাই আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে। আলাদাভাবে নিজেকে গড়তে হবে।’
২০০৭ সালের মিস বাংলাদেশ ও আইনজীবী জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া বলেন, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে। লক্ষ্যে অটুট থাকতে হবে৷ কারণ, নিজের ভালো নিজের থেকে অন্য কেউ বেশি বুঝবে না।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিলভিয়া নাজনীন।