১৩ উপজেলার কিশোরগঞ্জে আছে ৬টি সংসদীয় আসন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টির মধ্যে তিনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাবেক তিন রাষ্ট্রপতির চার সন্তান। এর মধ্যে তিনজন লড়ছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে। একজন আছেন স্বতন্ত্র পরিচয়ে। স্থানীয় মানুষেরা বলছেন, দুটি আসনে নৌকার জয় কেবল সময়ের ব্যাপার। তবে একটিতে লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আবার সেই লড়াই হবে সাবেক এক রাষ্ট্রপতির দুই সন্তানের মধ্যে।
এক জেলায় সাবেক তিন রাষ্ট্রপতির চার সন্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা, বিশেষ করে একটিতে ভাই-বোনের লড়াই নিয়ে আলোচনা এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দুই সন্তান। মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া নূর লড়ছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে। তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য। তাঁর বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর পর শূন্য আসনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি সংসদ সদস্য হন। দল এবারও তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে শেষে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম। তিনি লড়ছেন ইগল প্রতীক নিয়ে।
স্থানীয় ভোটাররা বলেন, আসনটিতে নৌকার জয়ের বড় বাধা ঈগল। যতই দিন যাচ্ছে, ভাই-বোনের বাগ্যুদ্ধ ততই বাড়ছে। ভাই-বোনের লড়াইয়ের জন্য সৈয়দ পরিবারের সদস্যরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মাঠ গরম করে রেখেছেন। এই নিয়ে দলও কিছুটা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই আসনে নৌকার প্রার্থী ছাড়াও আছেন আরও পাঁচজন।
ছোট বোন সৈয়দা জাকিয়া নূরকে পরাজিত করার চ্যালেঞ্জ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাফায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বড় ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর ছোট বোন লিপিকে (জাকিয়া নূরকে) দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়। বিষয়টি মেনে নিয়েছিলাম। এখন দেখছি, গত পাঁচ বছরে এ আসনে কোনো উন্নয়ন তো দূরে থাক, এমনকি আমার ভাইয়ের করা উন্নয়নমূলক কাজগুলোরও সংস্কার করা হয়নি। এই অবস্থায় এলাকার মানুষ বিকল্প প্রার্থীর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সে জন্য আমি দলের মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কিন্তু দল আমাকে মনোনয়ন না দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ায় ভোটারদের দাবিতে আমি নির্বাচন করছি। আশা করি ভোটের মাধ্যমে নৌকা প্রতীক ভুল জায়গায় দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে সৈয়দা জাকিয়া নূর বলেন, ‘আমি আমার বড় ভাইয়ের (সাফায়েতুল ইসলাম) উদ্দেশে বলতে চাই, আমাদের রক্ত খাঁটি, আমাদের রক্ত পরীক্ষিত। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। নৌকা আমার পরিবারের মার্কা। আল্লাহর কসম, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমি যদি নৌকা মার্কা না পেতাম, তাহলে কখনো স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করতাম না। অথচ আমার বড় ভাই তা-ই করেছেন।’
ভাই-বোনের লড়াই প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান বলেন, নির্বাচন করা গণতান্ত্রিক অধিকার। আর প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন দলের পক্ষ থেকেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তাই নির্বাচন করাতে দোষের কিছু নেই। তবে কথাবার্তা সবাইকেই আরও সংযত ও আরও সতর্কভাবে বলার পরামর্শ দেন তিনি।
‘সহজ জয়ের’ আভাস
ভৈরব-কুলিয়ারচর নিয়ে কিশোরগঞ্জ-৬ আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের ছেলে। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এই আসনে নাজমুল হাসান ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরও ছয় প্রার্থী।
কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে নৌকার মাঝি রেজওয়ান আহাম্মদ সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ছেলে। আসনটি জেলার হাওর অধ্যুষিত ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন উপজেলা নিয়ে গঠিত। রেজওয়ান বর্তমান সংসদ সদস্য। এই নিয়ে রেজওয়ান টানা চতুর্থবারের মতো দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এই আসনেও মোট প্রার্থী ছয়জন মাঠে আছেন।
এ দুই আসনের ভোটার ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ-৪ ও ৬ আসনে নৌকার বিপরীতে লড়াই শক্তিশালী কেউ মাঠে নেই। কারণ, অপর প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে পরিচিত নন। প্রার্থীরা নিজেরাও সেটা বুঝে গেছেন। তাঁরা ভালোভাবে প্রচারণায় নেই। এমনকি প্রতীক পাওয়ার পর অধিকাংশ প্রার্থী নির্বাচনী এলাকাতেও নেই। কারও কাছে ভোটও চাচ্ছেন না, নেই সভা-উঠান বৈঠক। তবে কেউ কেউ দায়সারা কিছু পোস্টার সাঁটিয়ে আর কিছুদিন পরপর মাইকিং করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মধ্যে প্রচারণা সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন।
এই দুই আসনের নৌকার প্রার্থীরাও নিজেদের জয় নিয়ে চিন্তা করছেন না। তাঁদের সব ভাবনা ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো নিয়ে। নির্বাচনী সভায় তাঁরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন, যেন ৭ জানুয়ারি ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যান।
নিজের জয়ের ব্যাপারে কতটুকু আশাবাদী? এমন প্রশ্নে নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমার এখানে হার-জিতের নির্বাচন নয়। অংশগ্রহণের নির্বাচন। কত মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবেন, এটাই মেজর (মূল) চ্যালেঞ্জ।’
রেজওয়ান আহাম্মদও বলেন, নিজের জয় নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। তাঁর যতটুকু ভাবনা ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর রহমানও তাঁদের সহজ জয় পাওয়ার সম্ভাবনা আছে জানিয়ে বলেন, কিশোরগঞ্জ-৪ ও ৬ আসনে জয় পেতে সমস্যা হবে না।