নাফিসা হোসেন
নাফিসা হোসেন

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত নাফিসা জিপিএ ৪.২৫ পেয়েছেন, মায়ের চোখে পানি

এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করায় ভীষণ খুশি ধামরাইয়ের শরীফুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের জন্য মিষ্টি কিনতে তাই বাজারে এসেছেন তিনি। শরীফুলের মতো সারা দেশে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের স্বজনেরা আজ বেজায় খুশি। কেউ কেউ খুশিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এসব কৃতকার্য শিক্ষার্থীরই একজন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মারা যাওয়া নাফিসা হোসেন মারওয়া। তবে তাঁর মায়ের মুখ মলিন। কারণ, যার ফলাফল, সে–ই তো পৃথিবীতে নেই।

নাফিসা হোসেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে সাভারে মারা যান। ঘটনার দিন মামার নিষেধ না শুনে মামার বাসা থেকে পালিয়ে অংশ নিয়েছিলেন আন্দোলনে। দুপুরের পর সাভার মডেল মসজিদ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সেই নাফিসার এইচএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে আজ। তিনি গাজীপুরের টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ২৫ পেয়ে পাস করেছেন।

২০২২ সালে নাফিসার মা কুলসুম বেগম পারিবারিক সমস্যার কারণে দুই মেয়েকে নিয়ে সাভারের দক্ষিণ বক্তারপুরে কোর্টবাড়ি এলাকায় চলে আসেন। এরপর তিনি মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিদেশে পাড়ি জমান। নাফিসাকে ভর্তি করা হয় সাভারের বেসরকারি ল্যাবরেটরি কলেজে। গত বছরের শেষের দিকে নাফিসার বাবা আবুল হোসেন নাফিসাকে টঙ্গীতে নিয়ে যান। তিনি নাফিসাকে সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে নাফিসা অধিকাংশ সময়ে সাভারে মামা মো. হযরত আলীর বাসায় থাকতেন। গত ২৮ জুলাই ধামরাইয়ে বড় মামার বাসায় আসেন। পরে ৩০ জুলাই ছোট মামা হযরত আলীর বাসায় যান। এরপর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে সাভারে আন্দোলনে অংশ নিতেন।

আগস্টের ৩ তারিখ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নাফিসা। ৫ আগস্ট সকালে মামাকে জানিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গাবতলীতে যাবেন। ঝামেলার বিষয়টি ভেবে মামা হযরত আলী আন্দোলনে যেতে নিষেধ করছিলেন; কিন্তু নাফিস নিষেধ শোনেননি। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর মামা নাফিসার মুঠোফোনে কল দিলে জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। তখন মামা তাঁকে রেডিও কলোনি হয়ে বাসায় ফিরতে বলেন। বেলা ১১টার দিকে আবার কল দিলে আর ধরেননি নাফিসা।

মেয়ে উত্তীর্ণ হলেও মায়ের মুখ মলিন। কারণ, যার ফলাফল, সেই তো পৃথিবীতে নেই

বেলা আড়াইটার দিকে নাফিসার ছোট বোন সাফা হোসেন কল দিলে অপরিচিত একজন কল ধরে ‘নাফিসা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন’ জানিয়ে ল্যাবজোন হাসপাতালে যেতে বলেন। বিষয়টি জানতে পেরে হযরত আলী ল্যাবজোন হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে নাফিসাকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখতে পান। কিছুক্ষণ পর চিকিৎসকেরা নাফিসাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আন্দোলনকারীরাসহ লাশ বাসায় নেওয়ার পথে মুক্তির মোড় এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ছররা গুলি ছোড়ে। এতে হযরত আলীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্সে বিকেল চারটার দিকে লাশ মামার বাসায় নেওয়া হয়।

রাত নয়টার দিকে সাভারে জানাজা শেষে নাফিসার মায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নানির বাসায় নাফিসার ছোট ভাইয়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে নাফিসার বাবা লাশ টঙ্গীর  এরশাদনগরে নিয়ে নিজ বাড়ির একটি কবরস্থানে দাফন করেন।

মামা হযরত আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটকাল থেকে নাফিসা সবার খুব আদরের ছিল। প্রচণ্ড ভালোবাসত আমাকে। সবাইকে বলত, আমি নাকি ওর সবচেয়ে পছন্দের মামা ছিলাম। আমি ওর দুনিয়া ছিলাম। খুব জেদি ও সাহসী ছিল।’

নাফিসার ইচ্ছা অনুসারে তাঁকে ২০২২ সালে সাভারের ল্যাবরেটরি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন মা কুলসুম বেগম। পরে দুই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাতারে পাড়ি জমান। মা বিদেশে থাকায় আন্দোলনের সময় মাকে মুঠোফোনে কল দিয়ে অনুমতি চেয়েছিলেন নাফিসা। মা তাঁকে আন্দোলনে গেলেও সাবধানে থাকতে বলতেন।

নাফিসার মা কুলসুম বেগম কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গ্রাফিক ডিজাইনার ও ফটোগ্রাফার হওয়ার শখ ছিল নাফিসার; কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। আজ রেজাল্ট দিছে; কিন্তু সেই রেজাল্ট দেখার মানুষটি তো নেই। আমি গর্বিত, আমার অনুমতি নিয়ে আন্দেোলনে গিয়েছিল, শহীদ হয়েছে। ওর স্বপ্ন পূরণের জন্য বিদেশে গেলাম। আর সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’

নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই নাফিসার মুঠোফোন থেকে একজন কল দিয়ে নাফিসার গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান। দ্রুত তাঁকে সাভারে যেতে বলেন। তিনি বহু কষ্টে টঙ্গী থেকে বেড়িবাঁধের ধউর পর্যন্ত গিয়ে আর যেতে পারেননি। মেয়ে জুলাইয়ে উত্তরায় আন্দোলনে যোগ দিলে তিনি নিষেধ করেছিলেন। পরে মামার বাসার গিয়ে সাভারে আন্দোলনে যোগ দেয়। মারা যাওয়ার আগে তাঁকে মোবাইলে সে বলে, ‘আব্বু আমি মারা গেলে লাশটা নিয়া যাইও।’ এদিকে নাফিসার স্মরণে কোর্টবাড়ি এলাকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।