অল্প বয়সে স্বামীর ঘরে এসেছিলেন ফিরোজা বেগম। কষ্টে কেটেছে অনেক বছর। পরে পরিবারের অভাব ঘোচাতে সঞ্চয়ের ১৫ হাজার টাকায় উন্নতজাতের একটি গাভি কিনে লালনপালন শুরু করেন তিনি। বছর ঘুরতেই সেই গাভি বাছুর জন্ম দেয়। গাভির দুধ বিক্রির টাকায় সংসারে চাকা ঘুরতে থাকে। বড় হতে থাকে বাছুরটি।
সেই থেকে ১২ বছরের মাথায় এখন ফিরোজার খামারে ১২০টি গরু। পাঁচজন কর্মচারী স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। গরুর দুধ বিক্রি, গরু মোটাতাজা করে বিক্রি ও বাছুর বিক্রি করে খরচ বাদে এখন তাঁর বছরে আয় ৪৬ লক্ষাধিক টাকা। এ আয় থেকে হয়েছে পাকা বাড়ি, কিনেছেন ২০ বিঘা কৃষিজমি। ফিরোজা ডেইরি ফার্ম নামে তাঁর খামারে আছে ফলের বাগান, মাছ চাষের পুকুর ও কৃষি চাষাবাদ। অভাবের দিন বদলে গেছে, এখন তাঁর দুধভাতে সুখের সংসার।
৪৮ বছর বয়সী সফল খামারি ফিরোজা বেগমের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়গঙ্গারামপুর গ্রামে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর স্বামীর নাম রেজাউল করিম। স্ত্রীর খামার ও সংসার দেখাশোনার পাশাপাশি গোখাদ্যের ব্যবসা করছেন তিনি। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। ফিরোজা বেগম নাটোরের সফল খামারির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ‘জয়িতা পুরস্কার-২০২৩’।
অভাবের সংসারে ফিরোজা বউ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে তাঁদের চেষ্টায় দিন ফিরেছে।রেজাউল করিম, ফিরোজার স্বামী
ফিরোজা বেগম বলেন, এখন তাঁর খামারে গরুর সংখ্যা ১২০। এর মধ্যে ৫০টি গাভি, এঁড়ে-বলদ আছে ৩০টি। ছোট ও মাঝারি আকারের বাছুর আছে ৪০টি। গেল কোরবানির ঈদে মোটাতাজা করে ১০টি গরু বিক্রি করেছেন। তাঁর খামারে ৫০টি গাভির মধ্যে ৩৮টি গাভি প্রতিদিন ৩২০ লিটার করে দুধ দিচ্ছে। সেই দুধ স্থানীয় একটি দুধ ক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি করে থাকেন। অনেকে আবার বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যান। ৫৫ টাকা লিটার দরে প্রতিদিন ১৭ হাজার ৬০০ টাকার দুধ বিক্রি করেন। দুধ বিক্রি থেকে মাসে আয় ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা, আর বছরে আয় ৬৩ লক্ষাধিক টাকা। গরু ও বাছুর বিক্রি করে বছরে আয় হয় ২৫ লক্ষাধিক টাকা। গোবর থেকে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদন থেকে মুনাফার পরিমাণ লাখ টাকা। বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ৮৯ লাখ টাকায়। এর মধ্যে গরুর খাবার ও চিকিৎসা বাবদ বছরে ব্যয় ৩৬ লাখ টাকা। পাঁচজন কর্মচারীর মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা হিসেবে বছরে ব্যয় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। এতে বছরের মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩ লাখে। সব খরচ বাদে তাঁর লাভ থাকে ৪৬ লক্ষাধিক টাকা।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ফিরোজার বড় ছেলে সাগর আহম্মেদ সোহাগ পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পরে চাকরি বাদ দিয়ে তিনি ঢাকায় পোশাক কারখানা দিয়েছেন। ফিরোজার মেয়ে সাথী ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে সংসারী হয়েছেন।
ফিরোজা বেগমের স্বামী রেজাউল করিম বলেন, অভাবের সংসারে ফিরোজা বউ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে তাঁদের চেষ্টায় দিন ফিরেছে।
উপজেলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের ৫৩০টি খামারে প্রতিদিন ১ লাখ ৫৯ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়ে থাকে। উৎপাদিত দুধের মধ্যে প্রাণ হাব কেনে ১৭ হাজার লিটার ও আড়ং কেনে ১৮ হাজার লিটার দুধ।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ফিরোজা ডেইরি ফার্মটি উদাহরণ। তাঁদের অনুসরণ করে অনেক বেকার অভাব ঘোচাতে পারেন। ওই খামারের কারণে দুগ্ধশিল্পের বিপ্লব ঘটেছে। উপজেলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের ৫৩০টি খামারে প্রতিদিন ১ লাখ ৫৯ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়ে থাকে। উৎপাদিত দুধের মধ্যে প্রাণ হাব কেনে ১৭ হাজার লিটার ও আড়ং কেনে ১৮ হাজার লিটার দুধ। এ ছাড়া অন্যান্য কোম্পানি, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও ব্যক্তিপর্যায়ে দুধ কেনা হয়ে থাকে।