নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রসবের চার দিনেও নবজাতককে কাছে না পেয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন এক প্রসূতি। পরে হাসপাতালের এক নারী ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে’ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের পর মাটিচাপা দেওয়া অবস্থায় নবজাতকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় উপজেলার হাড়িয়া এলাকার একটি লিচুবাগানে লাশটি পাওয়া যায়। হাসপাতাল থেকে একটি চক্র নবজাতকটিকে চুরি করেছিল বলে অভিযোগ করেছেন আকলিমা বেগম ওরফে রাজিয়া (৩০) নামের ওই নারী। এ ঘটনা আজ সোমবার থানায় বসেই এক লাখ টাকায় মীমাংসা করা হয়েছে বলেও দাবি আকলিমার। তবে পুলিশ বলছে, হাসপাতালে ওই নবজাতকের মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষ শিশুর মায়ের অনুমতিতে তাকে মাটিচাপা দেয়। চুরির ঘটনা না ঘটায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আকলিমা তাঁর সন্তানকে দত্তক দিয়েছিলেন। পরে কী হয়েছে, তা তারা জানে না।
আকলিমার বাবার বাড়ি সুনামগঞ্জে। তিনি স্বামীর সঙ্গে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে থাকতেন। তবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না উল্লেখ করে আকলিমা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এরই মধ্যে অসুস্থ বোধ করলে তাঁর এক বান্ধবী ভালো চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ নিয়ে আসেন। ১৪ অক্টোবর সোনারগাঁ মডার্ণ নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে জোর করে তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়। পরদিন জ্ঞান ফিরলে তিনি সন্তানকে দেখতে চান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শিশুটি অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এদিকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত সন্তানের খোঁজ না পেলে সন্তান চুরির বিষয়টি তিনি নিশ্চিত হন।
পরে গতকাল সকালে সোনারগাঁ থানায় এ বিষয়ে একটি অভিযোগ করেন আকলিমা। ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৮ অক্টোবর হাসপাতালের দায়িত্বরত লোকজনের মাধ্যমে কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি জানান, তাঁর বাচ্চা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তখন সন্তান বিক্রি বাবদ তাঁর হাতে কিছু টাকা দেওয়া হয়। তিনি টাকা ফেরত দিতে চাইলে হত্যার হুমকি দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেনের দাবি, আকলিমা বেগমকে জোর করে অস্ত্রোপচার করা হয়নি। সালমা নামের এক নারীর মাধ্যমে আকলিমা শিশুটিকে দত্তক দিয়েছিলেন। সালমা মাঝেমধ্যে তাঁদের হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসেন। তারপর কী ঘটেছে, সে বিষয়ে তাঁরা জানেন না।
এদিকে আকলিমা বেগম থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর সন্ধ্যায় সালমা নামের ওই নারীকে আটক করে পুলিশ। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী উপজেলার হাড়িয়া এলাকার একটি লিচুবাগান থেকে মাটিচাপা দেওয়া নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
আজ সোমবার সকালে আকলিমার লিখিত অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা সোনারগাঁ থানার উপপরিদর্শক ওলিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। লাশের সন্ধান দেওয়া সালমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ছেড়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওসি স্যার বিষয়টি জানেন।’
আজ বেলা তিনটার দিকে সোনারগাঁ থানা প্রাঙ্গণে আকলিমা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পরে ওসি তাঁকে মীমাংসার প্রস্তাব দিয়েছেন। আকলিমার ভাষ্য, ‘ওসি সাব বলছেন, “মামলা করলেও ওরা জামিন পেয়ে যাবে। মীমাংসা করে ফেলেন।”’
আকলিমা বেগম বলেন, পরে থানায় বসেই মীমাংসা হয়েছে। তাঁকে এক লাখ টাকা দিয়ে একটি কাগজে সই নেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর আর কোনো অভিযোগ নেই। থানা থেকে বলা হয়েছে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু। ময়নাতদন্তে হত্যা বলে প্রমাণিত হলে পুলিশ নিজ থেকেই ব্যবস্থা নেবে। এ সময় তিনি দাবি করেন, সন্তান চুরির সঙ্গে জড়িত সালমাসহ অন্যদের যেন বিচার হয়।
কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে পুলিশের নির্দেশে একটি সাদা প্রাইভেট কারে উঠে বসেন আকলিমা। তারপর দ্রুতই গাড়িটি থানা ছেড়ে চলে যায়। এই গাড়িই তাঁকে সুনামগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা।
আকলিমার অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি হাসপাতালেই শিশুটির মৃত্যু হয়। পরে শিশুর মায়ের অনুমতিতে তাকে হাড়িয়া এলাকায় মাটিচাপা দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নবজাতকের মায়ের কোনো অভিযোগ না থাকায় এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা নেওয়া হয়েছে। শিশুটির লাশ ময়নাতদন্তের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মামলার বদলে থানায় বসে এক লাখ টাকায় মধ্যস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা আমার বিষয় নয়। নারী চান, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর মামলা করতে। তাই আমরা একটি অপমৃত্যুর মামলা নিয়েছি।’
আটক নারীকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, সালমা হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। সালমা জানতেন শিশুটি কোথায়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর শিশুটির লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পরে বিকেলে ওসি ফোন করে দুই পক্ষের মধ্যস্থতার বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মাধ্যমে তো কিছু করতে পারি না, করিও নাই। ওই মহিলা গরিব মানুষ। কারও মাধ্যমে তাঁর যদি উপকার হয়, আমরা তাতে কান দিই নাই।’