এম এ লতিফ ও জিয়াউল হক
এম এ লতিফ ও জিয়াউল হক

চট্টগ্রাম-১১

নৌকার সঙ্গে নেই বড় তিন নেতা 

  • আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও জ্বালানির মূল কেন্দ্রবিন্দু এই আসনের এলাকা। 

  • চট্টগ্রামের ১৬ আসনের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট—৫ লাখ ১৬ হাজার ৯৮৩টি। 

চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা-ইপিজেড) আসনে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন তিনবারের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। তবে এবার নৌকার সঙ্গে নেই নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ বড় তিন নেতা। তাঁরা দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হককে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এই দুই প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঘিরে দুই ধারায় বিভক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও। 

চট্টগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন ধরা হয় বন্দর-পতেঙ্গাকে। কারণ, এখানে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, টানেল, জ্বালানি পরিশোধন কারখানাসহ রাষ্ট্রীয় বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশন বা কেপিআই) রয়েছে। সারা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। অর্থাৎ সারা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও জ্বালানির কেন্দ্রবিন্দু এই এলাকা। 

নৌকার প্রার্থী তিনবারের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। স্বতন্ত্র হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক।

প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সবাইকে পাশে না পেলেও এম এ লতিফের ভরসা পুরোনো ভোটব্যাংক। এক দশকের বেশি সময় ধরে ‘স্বাধীনতা নারী শক্তি’ নামে নারীদের একটি সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন। আবার নিম্ন আয়ের মানুষকে কম মূল্যে খাদ্যসহায়তাসহ নানা কর্মসূচি চালু রেখে ‘ভোটব্যাংক’ শক্ত করেছেন বলে মনে করেছেন ভোটাররা। অন্যদিকে জিয়াউল হকের বড় ভরসা শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি। তিন বড় নেতা তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। তা ছাড়া ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি তিনি, যেখানে সবচেয়ে বেশি ভোটার রয়েছে। তাঁর পক্ষে আছেন বাকি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশও। 

তবে ভোটারদের মতে, নির্বাচনের মাঠে নেতা-কর্মীদের সমর্থনের চেয়ে বড় বিষয় নিজেদের সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে নেওয়া। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের উৎসাহ কম। এ জন্য ভোটের দিনে কেন্দ্রে ভোটারদের নেওয়াই হবে দুই পক্ষের আসল পরীক্ষা। 

সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ড নিয়ে বন্দর-পতেঙ্গা-ইপিজেড আসন। এই ১০টি হলো ২৭ থেকে ৩০ ও ৩৬ থেকে ৪১ নম্বর ওয়ার্ড। এই আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১৬ হাজার ৯৮৩ জন, যা চট্টগ্রামের ১৬ আসনের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি।

কেন নেতারা পাশে নেই

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি থেকে এই আসনে ২০০৮ সালে প্রথমবার নির্বাচনে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন এম এ লতিফ। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সংসদ সদস্য হওয়ার পর বড় নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। তা প্রকাশ্যে আসে লতিফ মনোনয়ন পাওয়ার পর। নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন—এই তিন বড় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হকের সমর্থনে প্রচারণা সভায় অংশ নেন। এ ছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) বড় অংশই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। অবশ্য গতকাল মঙ্গলবার বড়পোল এলাকায় এম এ লতিফের পক্ষে সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীসহ নগরের নেতাদের একাংশ গণসংযোগে অংশ নিয়েছেন।

জানতে চাইলে এম এ লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগর আওয়ামী লীগের তিন নেতা নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা অন্য নেতাদের নৌকার বিপক্ষে কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে নগর-তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই আমার পক্ষে আছেন।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে দিয়ে মূলত বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাঁরা।’

অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক আট বছর আগে প্রথমবার সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পরে ২০২১ সালেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। দুই দফা কাউন্সিলর হওয়ার পর এবার সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। 

স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সংসদ সদস্যকে কখনো পাশে পাননি। এ জন্য নগর থেকে শুরু করে তৃণমূলের গুটিকয় নেতা ছাড়া সবাই আমার পাশে রয়েছেন।’

এম এ লতিফের অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এম এ লতিফের অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেক রাগ-ক্ষোভ ও কষ্ট আছে। ১৫ বছর ধরে সংসদ সদস্য তাঁদের অবজ্ঞা–অবহেলা করেছেন। তাই তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। আমরাও তৃণমূলের সেন্টিমেন্ট ধারণ করি। আর দল সুযোগ দিয়েছে তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। জিয়াউল হক আন্দোলন-সংগ্রামের পরীক্ষিত মানুষ।’

প্রচার কেবল নৌকা-কেটলির

গতকাল বন্দর-পতেঙ্গা আসনের পশ্চিম মাদারাড়ী, আগ্রাবাদ, বিমানবন্দর সড়ক, এছাক ডিপোর পাশে হিন্দুপাড়া, ইপিজেড ও বন্দরটিলা ঘুরে দেখা যায়, মূল সড়কের পাশে ও অলিগলিতে নির্বাচনের পোস্টারে ছেয়ে গেছে। এই আসনে সবচেয়ে বেশি পোস্টার-ব্যানার ও নির্বাচনী কার্যালয় দেখা গেছে নৌকা ও কেটলি প্রতীকের। এ আসনে অন্য প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানার ছিল কম।

বিভিন্ন স্থানে নানা শ্রেণি–পেশার নয়জন ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সুষ্ঠু ভোট হলে তাঁদের অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা বলেছেন। কারও ভোট নিয়ে আগ্রহ নেই। ইপিজেড এলাকার ভোটার জানে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আসনে ভোট যাকেই দিই—জিতবে আওয়ামী লীগ। এরপরও ভোট দেওয়ার ইচ্ছে আছে। আগ্রাবাদ এলাকায় কথা হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল হাকিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভোটার হওয়ার পর একবারই ভোট দিতে পেরেছি। আরেকবার দৌড়ানি খেয়েছি।’ 

এই আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে আছেন পাঁচ প্রার্থী। তাঁরা হলেন ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের আবুল বাশার মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন (চেয়ার), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মহি উদ্দিন (একতারা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নারায়ণ রক্ষিত (আম), গণফোরামের উজ্জ্বল ভৌমিক, (উদীয়মান সূর্য) ও তৃণমূল বিএনপির দীপক কুমার পালিত (সোনালী আঁশ)। 

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

নৌকা ও কেটলি প্রতীকের প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে আসছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হকের অভিযোগ, শুরু থেকে নৌকার প্রার্থীর অনুসারীরা ব্যানার-পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা ও নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত একজনের ওপর হামলা ও কর্মী-সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এ নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে সাতটি অভিযোগ দেওয়ার কথা জানান তিনি।

একইভাবে জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে নৌকার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাতে না যান, সে জন্য ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন এম এ লতিফ। তবে প্রতিপক্ষের কোনো নেতা-কর্মীর ওপর তাঁর কর্মী-সমর্থকের হামলার কথা অস্বীকার করেন তিনি। 

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হলেও দুই পক্ষকে প্রচারণায় নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করতে দেখা যায়। কদমতলী এলাকায় দেখা যায়, রাস্তার এক পাশে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হকের নির্বাচনী ক্যাম্প। ইপিজেড এলাকায় রাস্তার পাশে কেটলি প্রতীকের তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে ব্যাপারীপাড়ার মোড়ে ফুটপাতের ওপর নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে। আগ্রাবাদ সিডিএ ৯ নম্বর সেতুর ওপর নৌকা প্রতীকের নির্বাচনী ক্যাম্প বসানো হয়েছে।