বিএনপির ডাকা তিন দিনের অবরোধের প্রথম দিনে বগুড়ায় পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা পিকেটিংয়ের চেষ্টা করেb। পুলিশ বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। পুলিশ শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে অবরোধ-সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল থেকে বগুড়া সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাফতুন আহমেদ খানের নেতৃত্বে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কয়েক শ নেতা-কর্মী বাঘোপাড়া বন্দরের পাশে পেট্রলপাম্পের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। বেলা ১১টার দিকে বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শতাধিক সদস্য অবরোধকারীদের সরিয়ে দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়েন। বিএনপি নেতা-কর্মীরা ইটপাটকেল ও ককটেল ছুড়ে পাল্টা জবাব দেন। একপর্যায়ে অবরোধকারীরা পিছু হটে পাশের ইটভাটা হয়ে গা ঢাকা দেন।
এ সময় মহাসড়কে আটকে পড়া দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসসহ বেশ কিছু যানবাহন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গোকুল খোলারঘরের দিকে এগিয়ে গেলে অবরোধকারীরা আবারও মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় গোকুল বন্দরে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের একটি বাস, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসের একটি কাভার্ড ভ্যানসহ বেশ কিছু যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাঘোপাড়া এলাকায় ফিরে এলে উত্তেজনা দেখা দেয়।
এর আগে সকাল সাতটার দিকে শহরের নওদাপাড়া এলাকায় অবরোধ-সমর্থকেরা সিলেট থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা হানিফ পরিবহনের একটি বাস, চট্টগ্রাম থেকে গাইবান্ধা অভিমুখী জান্নাত পরিবহনের একটি বাসসহ বেশ কিছু যানবাহন ভাঙচুর করেন। অবরোধকারীদের ইটপাটকেলের আঘাতে জান্নাত পরিবহনের কোচচালক সিদ্দিকুর রহমান (৪৫) আহত হয়েছেন। তাঁকে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকায়।
জান্নাত পরিবহনের চালকের সহকারী মনোয়ার হোসেন বলেন, রাত আটটায় ৪৯ জন যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল ছয়টার আগেই গাইবান্ধায় পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু গাজীপুরে যানজটে তিন ঘণ্টা আটকে পড়ায় বগুড়ায় পৌঁছাতেই সকাল সাতটা বেজে যায়। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়ার নওদাপাড়ায় পৌঁছার পর অবরোধকারীরা লাঠিসোঁটা হাতে বাসে হামলা করেন। যাত্রীরা প্রাণভয়ে চিৎকার–চেঁচামেচি করলে বাস থামিয়ে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অবরোধকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে চালক আহত হন।
ভাঙচুর হয়েছে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা দিনাজপুর অভিমুখী হানিফ পরিবহনের একটি বাসও। বাসটিতে একজন বিদেশিসহ ৪০ জন যাত্রী ছিলেন। বাসের যাত্রী নীলফামারীর আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম বলেন, সন্ধ্যা ৭টায় তাঁরা হানিফ পরিবহনের বাসটিতে সিলেট শহরের কদমতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। সকাল ছয়টার মধ্যে দিনাজপুরে পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু গাজীপুরে যানজটে আটকে থাকতে হয়। সকালে বগুড়ায় পৌঁছানোর পর অবরোধকারীরা ইটপাটকেল ছুড়ে বাস আটকে দেন।
একই বাসের যাত্রী দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবির রেজা বলেন, কাল বুধবার থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতেই সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ বাড়ি থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। অবরোধে আটকা পড়ে অবর্ণনীয় দুভোগ পোহাতে হচ্ছে।
একই বাসে যাত্রী ছিলেন লাইফ প্রোজেক্ট ফর ইয়ুথের বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর পোল্যান্ডের তরুণী অ্যালিসন ম্যাগনিজ। তিনি বলেন, সকাল ছয়টায় তাঁর লালমনিরহাটের তুষভান্ডারে পৌঁছার কথা ছিল। পাঁচ ঘণ্টা বাসে আটকা পড়ে আছেন।
এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের বনানী মোড়ে (বেতগাড়ি–লিচুতলা) অবরোধকারীরা বেশ কিছু গাড়ি আটকে দেন। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অবরোধকারীদের সরিয়ে দিতে গেলে আওয়ামী লীগ-পুলিশ একজোট হয়ে বিএনপির ওপর চড়াও হয়। এ সময় দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে অবরোধকারীরা কয়েকটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করেন। ভাঙচুর করা হয় বেশ কিছু যানবাহন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের দুই পাশে সব রকম যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। ঠনঠনিয়া টার্মিনাল ও চারমাথা বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ রুটে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। অন্য কোনো গন্তব্য গন্তব্য থেকেও বাস ছেড়ে আসেনি। তবে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও ওষুধ পরিবহনকারী যানবাহন চলছে।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে জনগণ সর্বাত্মক কঠোর অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা মহাসড়কে শান্তিপূর্ণ অবরোধ পালন করলেও পুলিশ বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে।
বগুড়ার শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা বেআইনি কাজ। কোথাও কেউ মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তা সরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে।