সীমান্তের কাছে পাশাপাশি দুটি বাড়িতে দুই পরিবারের বসবাস। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চিকাডর গ্রামে
সীমান্তের কাছে পাশাপাশি দুটি বাড়িতে দুই পরিবারের বসবাস। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চিকাডর গ্রামে

সীমান্তের দুই বাড়ি

খেতের ধান, হাওরের মাছ, উঠানের সবজি; আর কী লাগে

ভারতের মেঘালয়ের সীমান্তলাগোয়া সবুজ-শ্যামল একটি গ্রাম। শূন্যরেখার প্রায় এক কিলোমিটার দূরের এই গ্রামের নাম চিকাডর। অবস্থান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। গ্রামটির অন্তত আধা কিলোমিটার দূরে অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে পাশাপাশি দুটো বাড়ি। এক বাড়ির চেয়ে অন্য বাড়ির দূরত্ব এক শ গজ হবে। আপন দুই ভাই তাঁদের পরিবার নিয়ে বাড়ি দুটোয় বসবাস করছেন।

গত শুক্রবার শীতের দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ি দুটোর আঙিনায় দাঁড়িয়ে সীমান্তের ওপারে থাকা উঁচু–নিচু টিলা আর ঘরবাড়ি দেখা যায়। বাংলাদেশ অংশে সদ্য কাটা আমন ধানের পরিত্যক্ত জমিতে চরে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগল। বাড়ির এপাশ-ওপাশে খাবারের সন্ধানে ঘুরঘুর করছে হাঁস–মুরগি আর সাদা বক। কাঁচা পেঁপে আর বরই ঝুলছে গাছে। বাতাসে দুলছে শীতকালীন নানা প্রজাতির সবজির গাছ-পাতারা। খেতে মাচাভর্তি শিম আর লাউ ঝুলছে। একটু দূরে, সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় শুকিয়ে আসা দপ হাওরে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন জনাপাঁচেক মানুষ।

আশপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে এক বাড়ির উঠানে পা রাখতেই টিনশেডের ঘরটি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কারে চাই? আফনারা কারেন্টের লোকনি?’ নিজেদের পরিচয় জানালে তিনি বসানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তখনই জানালেন, তাঁদের এই দুই বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। সৌরবিদ্যুতে তাঁরা চলেন। কয়েক দিন আগে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকেরা এসে দেখে গেছেন। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই বৈদ্যুতিক খুঁটি পড়বে তাঁদের উঠানে।

ওই ব্যক্তির নাম বাবুল মিয়া (৫৭)। তিনি বলেন, গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে, সীমান্তের কাছাকাছি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা দিয়ে ২০১৮ সালে তিনি ১৫ শতাংশ জায়গা নেন। এরপর ঘর তৈরি করে এখানে পরিবার নিয়ে বসবাসের জন্য পাশের শাহ আরেফিন টিলা এলাকা থেকে চলে আসেন। স্ত্রী, পাঁচ মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুই সন্তান পড়াশোনা করছে। মেয়েটা দশম শ্রেণিতে আর ছেলেটা নবম শ্রেণিতে পড়ছে। বর্গাচাষ করেই তিনি সংসার চালান।

বাবুল মিয়া বলেন, আমন ও বোরো—দুই ফসলি জমি তাঁদের এখানে। কিছুদিন আগে আমন ধান কাটা শেষ হয়েছে। বর্গাচাষে তিনি ৩০ মণ ধান পেয়েছেন। নিজেদের খাওয়ার জন্য কিছু ধান রেখে বাকি ধান বিক্রি করে দেবেন। নিজ হাতে ফলানো ধান, পাশের হাওর থেকে শিকার করা তাজা মাছ আর বাড়ির উঠানে সারহীন ফলানো সবজি দিয়ে চলে তাঁদের নিয়মিত আহার। এ ছাড়া গৃহিণীর পালিত হাঁস-মুরগি আর সেগুলোর ডিম তো আছেই। তেল আর মসলা ছাড়া অন্য জিনিস খুব একটা কেনা লাগে না বলে তিনি জানালেন।

সীমান্তের কাছে নিজেদের মতো সুখের জীবন গড়েছেন দুই ভাই

বাবুল মিয়ার ভাষায়, ‘নিজের চাষের ধান আছে। মাছেরও অভাব নাই। হাওর থাকি মাছ ধরি আর বাড়ির সবজি তো আছেই। সব টাটকা জিনিস আমরা খাই। বিশুদ্ধ বাতাস, বাইচ্চাকাইচ্চারার রোগশোকও খুব একটা হয় না। বড় আরামে আছি। আশপাশে কুনু বাড়িঘর না থাকায় কাইজা-ফ্যাসাদও নাই, ঝায়ঝামেলায়ও পায় না। কাজ করি, খাইদাই আর ঘুমাই। বাড়তি চিন্তা নাই। কিছু অভাব থাকলেও সুখের কমতি নাই।’

বাবুল মিয়ার পাশের বাড়িটি তাঁর ছোট ভাই শামসু মিয়ার (৫০)। সে বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলে শামসুর ত্রিশোর্ধ্ব স্ত্রী মনোয়ারা আক্তারের। তাঁর কাছে চিকাডর গ্রাম থেকে এক নারী দেখা করতে এসেছেন। ওই নারীকে গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা কাঁচা সুপারি কেটে দিয়ে আপ্যায়ন করছিলেন তিনি। মনোয়ারা বলেন, তাঁদের ভিটেজমি ছিল না। দুই বছর আগে স্থানীয় প্রশাসন সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাসজমিতে একটি ছোট আধা পাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছে। এখানেই তাঁরা থাকছেন। তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। শারীরিক অক্ষমতার কারণে ভারী কাজ করতে পারেন না। কেবল মাঝেমধ্যে তিনি পাশের হাওরে নিজেদের খাবারের জন্য মাছ ধরতে যান। তাই অন্যের বাড়ি কাজ করে তাঁকেই সংসার চালাতে হচ্ছে। তাঁদের চার মেয়ে ও এক ছেলে।

অন্যের বাড়ি কাজ করে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন মনোয়ারা। তবে সে কাজও আবার মাসের অর্ধেক সময় পান না। মনোয়ারা বলেন, ‘হাওর থাকি হিঙ্গি, কই, মাগুরসহ ছোট-বড় মাছই ধইরা আনইন তান (মনোয়ারার স্বামী)। মাছ, ভাত, সবজি—সব ফ্রেশ। সংসার চালাইতে কষ্ট হয়। অভাব আছে, তবে অশান্তি নাই।’