রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটের সীমান্ত এলাকাগুলোয় চোরাচালান অনেকটা বন্ধ ছিল; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবারও সক্রিয় হয়েছেন চোরাকারবারিরা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বদলে এখন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চোরাচালান চালু রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চোরাচালানে জড়িয়ে এরই মধ্যে বিএনপির দুই নেতা বহিষ্কার হয়েছেন। চোরাচালানের পণ্যসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন এক ছাত্রদল নেতার ভাই।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী শতাধিক স্থান দিয়ে চোরাই পণ্য দেদার প্রবেশ করে। এর বাইরে জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার সীমান্তেও চোরাকারবারিরা তৎপর। তাঁরা ভারতের কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করে চোরাই পথে মাল আনছেন। এসব পণ্য স্থানীয়ভাবে ‘বুঙ্গার মাল’ নামে পরিচিত। এই ‘বুঙ্গার মালে’ সয়লাব সিলেটের বাজার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্তের বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, চোরাই পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসছে চিনি। চোরাকারবারিদের নিয়োগ করা শ্রমিকেরা দিন-রাত সুযোগ বুঝে ৫০ কেজির চিনির একেকটা বস্তা মাথায় করে সীমান্ত পার করেন। পরে নৌকা, মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মজুত করা হয়। এরপর একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় এসব চিনি সিলেট নগরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। একইভাবে প্রসাধনসামগ্রী, কাপড়, মাদক, আপেল, কম্বল, গরুসহ বিভিন্ন পণ্য আসছে।
বিভিন্ন অভিযানে ‘বুঙ্গার মাল’ জব্দের ঘটনায় আড়াই মাসে ২৯টি মামলা করেছে সিলেট মহানগর পুলিশ। জেলা পুলিশ দুই মাসে চোরাচালানের মামলা করেছে ৩৭টি।
এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন) মেজর গাজী মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোরাচালান রোধে আমরা কঠিনভাবে দায়িত্ব পালন করছি। এখানে কোনো ছাড় দিচ্ছি না।’
চোরাকারবারিদের দেওয়া তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে চিনিসহ চোরাচালান সিন্ডিকেটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের হাতে। ক্ষমতার পালাবদলের পর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেন স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় সীমান্ত এলাকা থেকে চিনিসহ চোরাই পণ্য ট্রাক কিংবা পিকআপে করে এনে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে। এর বিনিময়ে তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন।
দুজন চোরাকারবারির ভাষ্য, আগে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার চিনি আসত। বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমেছে। এসব চিনি তামাবিল-জৈন্তাপুর-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে নগরের পাইকারি বাজার কালীঘাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। মহাসড়ক দিয়ে এখন প্রতি ট্রাক চিনি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায় পার করিয়ে দিচ্ছে কয়েকটি সিন্ডিকেট। একইভাবে অন্যান্য পণ্যের প্রকার অনুযায়ী ট্রাকপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিনি ব্যবসায়ী বলেন, আগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের অনুসারীরা মহাসড়ক দুটিতে পাহারা দিয়ে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চোরাই চিনির ট্রাক শহরে ঢোকাতেন। এখনকার সিন্ডিকেটটি নিজেদের স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছে।
১৩ অক্টোবর রাতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ওসমানীনগরে ভারতীয় চোরাই চিনির ট্রাক ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় পুলিশ ছয়জনকে আটক করে। এঁদের মধ্যে মহানগর বিএনপির দুই নেতাও ছিলেন। রাতেই ওই দুই নেতাকে বিএনপি বহিষ্কার করে। তাঁরা হলেন বিএনপির সিলেট মহানগরের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মো. সোলেমান হোসেন ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মান্নান। এর বাইরে চিনি চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ওয়ার্ড বিএনপির এক সহসভাপতিকেও কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছেন।
এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিলেট সদর উপজেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব রুফিয়ান আহমদের ভাই সুফিয়ান আহমদসহ তিনজনকে চোরাচালানের ৫০ বস্তা চিনিসহ বটেশ্বর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে শাহপরান থানা–পুলিশ।
শুধু চোরাচালান নয়, বিএনপি কিংবা সহযোগী সংগঠনের যে কারও বিরুদ্ধে অনৈতিক অভিযোগের প্রমাণ পেলে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘বিএনপির সিলেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা প্রশাসনের সঙ্গে দেখা করে বলেছি, এই ব্যাপারে (চোরাচালান) বিএনপির কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। আমাদের (বিএনপি) কেউ তদবির করলে তাকেও যেন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়।’
‘বুঙ্গার চিনি’সহ চোরাই পণ্য জব্দ করতে পুলিশ শক্ত অবস্থানে আছে দাবি সিলেট মহানগরের পুলিশ কমিশনার মো. রেজাউল করিমের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরই মধ্যে চোরাচালানবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করেছি। চোরাকারবারিদের ধরার পাশাপাশি যেসব সন্ত্রাসী রাস্তায় চোরাই চিনি ছিনতাই বা চোরাচালানে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেটে ভারত থেকে চোরাই পথে সাধারণত চিনিই বেশি আসে। এর বাইরে বেশি আসে প্রসাধনসামগ্রী, বিভিন্ন ধরনের মাদক ও গরু। তবে সম্প্রতি আপেল ও কম্বল আসার ঘটনাও ঘটছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের চকলেট, চা-পাতা, বিস্কুট, কোমল পানীয়, হরলিকস, কাজুবাদাম, নানা ধরনের ক্রিম, স্পোর্টস বুট জুতা, পাতার বিড়িসহ বিভিন্ন পণ্য আসছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, বিজিবি ও পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। এ ছাড়া র্যাব-৯ চোরাই মাদকদ্রব্য উদ্ধারে কাজ করছে। এর পরও কিছু চক্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে চোরাচালান চালাচ্ছে। তবে চক্রের সদস্যরা নিয়মিত গ্রেপ্তারও হচ্ছেন।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের পীরেরবাজার এলাকায় ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা মূল্যের ১৯টি ভারতীয় কম্বলসহ একটি পিকআপ জব্দ করে পুলিশ। পাশাপাশি দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া একই দিন বিমানবন্দর থানা–পুলিশ ভারতীয় একটি কোম্পানির কোমল পানীয়র ২০০টি ক্যানসহ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
এর আগে গত ২৬ অক্টোবর সিলেট-গোলাপগঞ্জ সড়কের চারমাইল হাজীরবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ কাভার্ড ভ্যানে থাকা ১০ হাজার ৫৩৫ কেজি ভারতীয় আপেল জব্দ করে। এ সময় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের ভাষ্য, আগস্ট থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত মহানগর পুলিশ ‘বুঙ্গার মাল’ জব্দের ঘটনায় ২৯টি মামলা করেছে। এসব মামলায় ৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চিনি জব্দ করা হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫১ কেজি। এ ছাড়া ২৪টি ভারতীয় গরু, ৩১৮ প্যাকেট কিশমিশ, ৬ বোতল ভারতীয় মদ, ২০ হাজার শলাকা পাতার বিড়ি, ৩ হাজার ৯৬২ পিস শাড়ি, ২০২ পিস লেহেঙ্গা, অরিও বিস্কুট ৫ হাজার ৬০০ প্যাকেটসহ বিভিন্ন জোরাই পণ্য জব্দ করা হয়।
জেলা পুলিশ ও বিজিবিও নিয়মিতভাবে পৃথক অভিযানে চোরাই পণ্য জব্দ করেছে। জেলা পুলিশ জানিয়েছে, গত আগস্ট মাসে তারা চোরাই পণ্য জব্দের ঘটনায় ১৫টি মামলা করেছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৮ জন। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে দায়ের হওয়া ২২টি মামলায় গ্রেপ্তার হন ১৪ জন।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আপনারা দেখছেন, প্রতিদিনই কোনো না কোনো চোরাই মাল উদ্ধার হচ্ছে। চেকপোস্টও করছি। এখন বলা যায়, এটা প্রায় বন্ধ। আর হচ্ছে না।’
সিলেট নগরের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কালীঘাট এলাকার তিনজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সম্প্রতি ভারতে রসুন পাচারের ঘটনা বেড়েছে। কালীঘাট এলাকা থেকে রসুন কিনে নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সীমান্তবর্তী এলাকায় বিক্রি করছেন। পরে সেসব রসুনই চোরাকারবারিরা ভারতে পাচার করছেন। বিশেষ করে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্ত দিয়ে রসুন বেশি পাচার হয়। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের সীমান্ত দিয়েও রসুন পাচার হয়।
ওই ব্যবসায়ীরা জানান, আগে সিলেটে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে রসুন বিক্রি হতো। এখন সেই রসুনের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০ টাকা। সেসব রসুনই ভারতের বিভিন্ন খোলাবাজারে এখন ৩৮০ থেকে ৪০০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। লাভের পরিমাণ বেশি হওয়ায় রসুন পাচার ক্রমে বাড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, ২ অক্টোবর কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের জন্য নেওয়া ২ হাজার কেজি রসুন শাহ আরেফিন টিলা এলাকা থেকে জব্দ করেছে বিজিবি। এ ছাড়া ৩০ ও ৩১ আগস্ট একই উপজেলার সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিজিবি প্রায় ৬ হাজার কেজি রসুন জব্দ করে। এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর কোম্পানীগঞ্জ থানা–পুলিশ বটেরতল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৪০ কেজি রসুন উদ্ধার করেছে।
বিজিবি সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক (অপরারেশন) মেজর গাজী মুহাম্মদ সালাহউদ্দিনের দাবি, বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্য ভারতে পাচার হতে দেওয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, তিনি সম্প্রতি থানায় যোগদান করেছেন। পাচার বন্ধে তাঁরা সচেষ্ট আছেন। এ ছাড়া ভারত থেকে চোরাই পথে আসা ‘বুঙ্গার মাল’ জব্দেও তাঁরা নিয়মিত অভিযান করছেন।
তবে দুর্নীতি মুক্তকরণ বাংলাদেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালেও পাচারের তুলনায় জব্দ হচ্ছে কমই। ফলে কারবারিরা চিনিসহ চোরাই পণ্য নির্বিঘ্নে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। এর দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এড়াতে পারে না।